Pages

Wednesday, 1 May 2024

Offbeat Kashmir Trip (May - June 2022) - Part 3 : Srinagar To Gurez

Dal Lake

এবারের কিস্তিতে থাকবে শ্রীনগর থেকে গুৱেজ যাওয়ার অভিজ্ঞতা। সাথে জানাবো কিছু জরুরি টিপস। তাহলে চলুন শুরু করা যাক আরো একটা লম্বা পথচলার কাহিনী।
শ্রীনগরের সকাল
গতকাল রাতে আমরা বেশ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম - একে তো সেই ভোর চারটের থেকে জাগা তার উপরে এতো ট্রাভেল , শরীর বেশ ক্লান্ত ছিল যদিও মন চাঙ্গা হয়ে গেছিলো ভূস্বর্গের রূপ দেখে। যদিও ঘরটা খুব একটা কিছু ভাল ছিল না, তবুও ঘুমটা মোটামুটি ঠিকঠাকই হয়েছিল। ঘরের সবচেয়ে বড় প্রব্লেম ছিল বাইরের সব আওয়াজ আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম রুমের ভেতর থেকে। যাইহোক কিছু ঘন্টার ব্যাপার আর না ভেবে তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নিলাম।
ওদিন থেকেই শুরু হচ্ছিলো আসল অফবীট কাশ্মীরের যাত্রা। আসার আগে লিমিটেড ভিডিও/ লেখা পেয়েছিলাম গুরেজ নিয়ে তাই মনের মধ্যে অজানার হাতছানি,খানিকটা উৎকণ্ঠা আর একরাশ উত্তেজনা নিয়ে মুখিয়ে রইলাম দিনটার জন্যে।
গুগল ম্যাপ আপনাকে বলবে শ্রীনগর থেকে গুরেজ যেতে সময়ে লাগবে ৫-৬ ঘন্টা কিন্তু আপনি যখন যাত্রা শুরু করবেন বুঝবেন যে আরামসে ৭-৮ ঘন্টার ব্যাপার, তাও যদি আপনি শুধু মাঝে একবার লাঞ্চ ব্রেক নেন। যদি আপনি ব্লগার হন বা রাস্তায় থামতে থামতে যাওয়ার ইচ্ছে থাকে তাহলে আরো বেশি সময়ে লাগবে, যত বেশি স্টপ নেবেন সেই হিসাবে। তবে গুরেজ যাওয়ার আগে আমরা গুগল ম্যাপসকেই বিশ্বাস করেছিলাম, পরে বুঝতে পারি দেরি করা উচিত হয়নি, সে গল্পে আসছি ধীরে ধীরে।
হোটেলের খাবার যে ভাল নয় আগেই বলেছি, তাই ব্রেকফাস্টটাও বিশেষ ভাল লাগলো না। খুরশিদ ভাইকে বলা ছিল আমরা ৮:৩০ নাগাদ বেরোবো। ওকে কল করলাম ৭:৪৫ নাগাদ, কল লাগলো না - আউট অফ কাভারেজ বলছে। আমি জানতাম যে টানমার্গ থেকে শ্রীনগরের রাস্তায় কিছুটা স্ট্রেচ আছে যেখানে সিগন্যাল ভাল পাওয়া যায় না তাই রুমে গিয়ে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। রিসেপশনে বলা ছিল যদি গাড়ি এসে যায় তাহলে খবর দিতে। খানিক বাদে বয় এসে খবর দেয় গাড়ি নাকি এসে গেছে। সেইমতো আমরা রুম থেকে চেকআউট করে রিসেপশনে চলে এলাম। এসে দেখি ওটা অন্য কারো গাড়ি, বয় ভুল করে ভেবেছে আমাদের। আবার রুম এ গিয়ে লাভ নেই তাই আমরা রিসেপশনেই অপেক্ষা করবো ঠিক করলাম। পুরো হোটেলটায় একমাত্র রিসেপশন এরিয়াটাই একটু ভদ্রস্থ। বেশ কাশ্মীরি কারুকার্য করা গদিয়ালা চেয়ার পাতা। খুরশিদ ভাইয়ের তখন ফোন লাগছেনা। চেকআউট ফর্ম এ সাইন করতে রিসেপশন ডেস্ক এ ডাক পড়লো। সাইন হয়ে যাওয়ার পর ম্যানেজার জানতে চায় আমরা এর পর কোথায় যাচ্ছি। আসলে দুই মহিলা তার উপরে মা মেয়ে এমন কম্বো দেখতে হয়তো ওরা অভস্ত ছিল না তখনও, তাই এক দু জায়গায় আমাদের লোকে খুব কৌতূহলের সাথে প্রশ্নও করেছিল। আমি জানাই গুৱেজ। ভদ্রলোক বলেন সেটা কোথায় ! আমি হেসে বলি আপনাদের রাজ্যের জায়গা আর আপনি জানেন না, এ কেমন ব্যাপার ! তারপর আমি এক্সপ্লেইন করি গুৱেজ বলতে কি জায়গা বোঝাচ্ছি। তিনি তখন মাথা চুলকে মনে করার চেষ্টা করেন তারপর বলেন- শাবির ভাই বলেছিলেন বটে এরম জায়গার নাম। আমি আমার কিছু ফ্যামিলির লোকেদের ওখানে পাঠাতে চাই। আমি বললাম বেশ তো। তখন তিনি বলেন যে তিনি আমাকে কল করে জানবেন যে গুৱেজ কেমন লাগলো তারপর ডিসাইড করবেন। আমি তাতে হ্যাঁ বলে চলে আসি। পরে কিন্তু ওনার আর কল আসেনি।
আমরা একটু হেটেলের বাইরে ঘোরাঘুরি করি, সকালের নরম রোদ বেশ ভালোই লাগছিলো। যেটা আগে বলা হয়নি, আমাদের হোটেলের উল্টো দিকে একটা সত্যিকারের আর্মি বাংকার ছিল, এইটা আমরা গতকাল রুম থেকেও লক্ষ্য করেছিলাম। এখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখলাম ওর মধ্যে একজন সশস্ত্র প্রহরী বন্দুক নিয়ে বসে আছে। এই হোটেলটা তুলনামূলক ভাবে খুবই শান্ত জায়গায় যেখানে বেশিরভাগ হচ্ছে লোকালদের বাড়িঘর, হোটেল বলতে হাতে গুনে দুখানি - তার মধ্যে সামনে এরকম বাংকার কোনো সেটা আর জিজ্ঞেস করা হয়নি।
এর কিছুক্ষনের মধ্যে খুরশিদ ভাই এসে পড়েন। বলেন যে হাইওয়ে তে ট্রাফিক ছিল তাই দেরি হয়ে গেল। আমরা মালপত্র ঢুকিয়ে বেরোতে বেরোতে প্রায় ৮ ৪৫ হয়ে গেল। সকালের সময়টা বেশ ভাল লাগছিলো, ঘুমন্ত শ্রীনগর, হালকা ঠাডার রেশ, কোথাও কোনো ট্যুরিস্টের ভিড় নেই - পুরো রাস্তা ফাঁকা, মাঝে সাঝে এক দুজন লোকালদের হেঁটে যেতে দেখা যাচ্ছে। আর একটা ব্যাপার যার জন্য কাশ্মীরকে বিদেশের মতো মনে হয়ে সেটা হচ্ছে এখানে একেবারেই রাস্তা ঘটে নোংরা পড়ে থাকতে দেখিনি, সেই সময়ে পর্যন্ত লিটারিং দেখিনি। আমরা খানিক গিয়ে কালকের সেই গ্রোসারি দোকানে আবার দাঁড়ালাম। আরো দুবোতল বিশ্লেরি, সাথে ডেল মোন্টের গ্রীন আপেল জুসার ক্যান, কিছু লেজের চিপস এর প্যাকেট সাথে নিয়ে নিলাম।


কাশ্মীরি কান্দুর (Kandurwan) আর কান্দুরের রুটি
একটা ইউনিক জিনিস নোটিশ করলাম সকালে সেটা হচ্ছে এক ধরণের লোকাল মোটা রুটি স্ট্যাক করে রাখা আছে একটা ঝুড়িতে। রুটিগুলো কিন্তু কোনো প্যাকেটের মধ্যে নেই, খোলাই রয়েছে। তখন দেখে অস্বাস্থ্যকর মনে হলেও পরে জানতে পারি এই রুটি গুলো কিন্তু সাধারণত এমন ভাবেই বিক্রি হয়ে থাকে লোকালি। একে বলে Tchot বা গির্দা। Tchot হল ঐতিহ্যবাহী কাশ্মীরি ফ্ল্যাটব্রেড, খানিকটা নানের মতো। এর ভেতরটা সামান্য নরম আর বাইরেটা খাস্তা হয়। কাশ্মীরে, প্রতিটি এলাকায় অন্তত একটি কান্দুর ওয়ান রয়েছে, যারা বিশেষ করে স্থানীয় রুটি বেক করে যেমন গির্দা, কাতলাম, কুলচা, শিরমাল, রোট ইত্যাদি। "কান্দুর" কথটির অর্থ "রুটি" এবং "ওয়ান" কথাটির অর্থ "দোকান"। তাই এগুলো হচ্ছে স্থানীয় রুটির দোকান বা বেকারি। এই বেকারি গুলো কিন্তু শুধুমাত্র কেনা বেচার জায়গা নয়, এগুলো হচ্ছে স্থানীয়দের একে ওপরের সাথে দেখা করে সকালের কিছুটা সময়ে গল্প গুজব করে কাটানোর জায়গা। একদিকে মাটির ভেতরে গভীর তন্দুরে হাত দিয়ে বানানো রুটি সেঁকা হয়ে আর অন্যদিকে চলে কাহওয়া বা নুন চায়ের সাথে সকালের আড্ডা। যারা কান্দুরে যেতে পারেন না বা আশেপাশে কান্দুর নেই, তাদের জন্য স্থানীয় গ্রোসারির দোকানিরা নিয়ে আসে কিছু রুটি। যদি এই রুটির স্বাদ নিতে হয়ে তাহলে সকাল সকাল যাওয়া ভাল কারণ এগুলো খুব তাড়াতাড়ি বিক্রি হয়ে যায়। আমাদের যেহেতু সেই মুহূর্তে এতো জ্ঞান ছিল না তাই ইন্টারেষ্টিং মনে হলেও কিনিনি, পরে আফসোস হয়েছিল (আমাদের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় কাশ্মীর ট্রিপ এ আমরা দরগাহ মার্কেট থেকে অনেক ধরণের কাশ্মীরি রুটি কিনেছিলাম )।

ডাল লেকের ভাসমান জীবন
আমরা যখন বুলেভার্ড রোড দিয়ে যাচ্ছিলাম দেখি ঘাটগুলো বেশ ফাঁকা আর দু পাঁচটা শিকারা এদিক ওদিক বাঁধা। যেহেতু গতকাল আমাদের শিকারার প্ল্যান ভেস্তে যায় তাই আমরা ভাবলাম এখন একবার চান্স নেওয়া যাক - এতো ফাঁকা যখন তখন হয়তো দরদাম বিশেষ করতে হবে না। গতকালের পর আমরাও জেনে গেছিলাম যে কাছের ঘাটগুলো থেকে বোটিং করা উচিত যাতে সাইটসিইং পয়েন্ট গুলো সব কাছে পাওয়া যায়। সেইমতো খুরশীদ ভাই আমাদের ঘাট #১৮ এ নিয়ে এলেন। এই ঘাটটা চিনতে খুব সুবিধা কারণ বিশাল একটা চিনার গাছকে ঘিরেই ঘাটটা তৈরী হয়েছে। আর এর উল্টো দিকেই গাড়ির পেইড পার্কিংও আছে। মা কে গাড়িতে রেখে, আমি প্রথমে গিয়ে দাম জিজ্ঞেস করে আসি। যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই - যেহেতু কোনো খদ্দের নেই তাই ৮০০ টাকা বললো এক ঘন্টার জন্যে। আমি আর দরাদরি না করে তাতেই রাজি হয় যাই ( ওটা ৬০০ বা ৭০০ করা যেত কিন্তু আমাদের হাতে সময়ে কম, গুরেজের জন্য বেরোতেই হবে এটা সেরে তাই দরাদরি করলাম না)। এর পর মা কেও ডেকে নিলাম।
যারা প্রথমবার শিকারা রাইড নেবেন তাদের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে এতগুলো টাকা কি সত্যি ওয়ার্থ শুধু লেকের ওপরে ভেসে বেড়ানোর জন্য? উত্তরটা হলো একদম ওয়ার্থ। আমার মনে হয়েছিল এর মধ্যে আর বিশেষ কি ফীল হবে, কিন্তু ভুল ভাঙলো শিকারা এ উঠে।
প্রতিটি শিকারার একটা সুন্দর নাম আছে যার জন্য মনে হয় এর মধ্যেও যেন প্রাণ আছে।
আমাদের শিকারার নাম - "দিলবর ফিরদৌস " আর বোট চালাচ্ছিলেন জাভেদ ভাই। শিকারা এ উঠতে আপনাকে আপনার চালকই সাহায্য করবে। জাভেদ ভাই একে একে আমাকে আর মা কে হাত ধরে তুলে দিলেন বোট এর মধ্যে। শিকারার দু প্রান্তে দু ধরণের বসার জায়গা - এক পাশে গদিটা অনেকটাই চওড়া আর অন্য পাশে দুজনের বসার মতো জায়গা। আমরা চওড়া গদির উপরে আরাম করে হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়লাম। বেশ একটা রাজকীয় ফিল আসছিলো। তারপর তিনি অদ্ভুত দক্ষতার সাথে ব্যালান্স করে নৌকার একেবারে ধার দিয়ে হেঁটে গিয়ে সামনে বসে পড়লেন। শিকারা দুলে উঠলো, জলে ছলাৎ ছলাৎ করে দাঁড় বাওয়ার আওয়াজ শুরু হলো - আমরা এগিয়ে চললাম সুন্দরী ডাল লেকের বুকের ওপর দিয়ে।
ভেনেসিয়ান গন্ডোলার মতো, শিকারা হচ্ছে কাশ্মীরের একটি সাংস্কৃতিক প্রতীক। এতো সুন্দর করে সাজানো প্রতিটা শিকারা - রংবাহারি বসার গদি, ঝালর দেয়া ছাদ আর রঙিন পান পাতার আকারের দাঁড়। শিকারে বসে আমরা জলের অনেক কাছে চলে আসি, আর সাথে সাথেই যেন ১-২ ডিগ্রির ফারাক হয়ে যায় টেম্পারেচের এ। বাইরে এতো রোদ, কিন্তু শিকারার ভেতরে ঠান্ডা, মনোরম পরিবেশ। সামনে পীর পাঞ্জলের বিশাল রেঞ্জ, নীল আকাশ, আর চারিপাশে রোদ পড়ে অভ্রের মতো চিকমিক করছে ডাল লেক।
জাভেদ ভাই অল্প স্বল্প গল্প জুড়ে দিলেন আমাদের সাথে। ওনার বয়েস বেশি না , জানালেন শিকারা উনি বছরের মধ্যে একটা পার্টিকুলার সময়েই চালান - বাকি সময়ে ড্রাই ফ্র্রুটের ব্যবসা দেখেন যার জন্য নাকি ওনাকে মুম্বাই, গোয়া যেতে হয়ে। সামনে দিয়ে একটা ছোট বোট আসছিলো আর তার দাঁড় বাইছিলো এক ৫-৬ বছরের ছোট্ট ছেলে - পাশে তার মা বসে। জাভেদ ভাই বললেন বাচ্চারা এখানে ছোট্ট বয়েস থেকেই নৌকা চালাতে শিখে যায় যেহেতু এদের জীবন জলের উপরেই কাটে।


ফ্লোটিং ভেজিটেবলে মার্কেট দেখার শখ সবারই থাকে কিন্তু যেহেতু অত সকালে ওঠার কুঁড়েমিটা কাটিয়ে ওঠা চাট্টিখানি কথা নয় তাই আমাদের সেটা অদেখাই রয়ে গেছে, কিন্তু চিন্তা করার কারণ নেই - ডাল লেকে ভাসতে ভাসতে আপনি হয়তো দেখতে পাবেন ফুলে ভরা নৌকা যেমন আমরা পেয়েছিলাম। তার সাথেই মাঝে মধ্যে আরো অনেক ভাসমান দোকানদারেরা আপনার শিকারার চার ধার দিয়ে ঘুরে বেড়ায়। চা, ভাজাভুজি, তুজ/ কাবাব , হ্যান্ডমেড জিনিস, গয়না, বাসনপত্র এরম হরেকরকমের জিনিস পাবেন আপনি ভাসমান নৌকাগুলোতে। তবে আমাদের কেনাকাটার তেমন কোনো ইচ্ছে ছিল না তাই আমরা মানা করে দিচ্ছিলাম সবাইকে।
এরপর আমরা মিনা বাজারে ঢুকে পড়ি। তখনও ভোরবেলা ছিল তাই সব দোকান খোলা ছিল না। রাতের তুলনায় অনেক শান্ত পরিবেশ। আমাদের মতো হাতে গোনা কয়েকটা টুরিস্ট শিকারা ঘুরছে। কিছু কিছু দোকান অবশ্য এর মধ্যেই খুলে গেছিলো আর তাদের শাড়ি, শালের সম্ভার দেখে বেশ লাগছিলো। এরকমই একটা দোকানে সাজিয়ে রাখা একটা কাশ্মীরি কাজের শাড়ি দেখে মায়ের ভালো লাগে। আমরা জাভেদ ভাইকে বললাম একটু কাছে নিয়ে চলুন, কিন্তু যেই না কাছে যাওয়া, ওই দোকানের লোকেরা আমাদের নিমেষে কনভিন্স করে নেয় ভেতরে আসার জন্য। নিমরাজি হয়ে আমরা শেষে উঠে পড়ি দোকানের উপরে। বাইরে থেকে যতনা বড় লাগছিলো , একটা ছোট দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখলাম ইয়া বড় দোকানটা। সারা দেয়াল জুড়ে ঠাসা শাল, শাড়ি, কার্পেট ইত্যাদি। কুশন ছিল বসার জন্যে। আমরা বসতেই দোকানি একে একে বের করে আনতে লাগলো দারুন সুন্দর হাতের কাজ করা জিনিস। পশমিনা গুলো দেখে সত্যি তাক লেগে গেলো। কিছু কেনার প্ল্যান না করে এসেও যখন বেরই দোকান থেকে তখন আমাদের ব্যাগে তিনটে শাল আর দুটো শাড়ি, যার মধ্যে দুটো পশমিনা শাল। অনেকেই হয়তো বলবেন ডাল লেকে থেকে কিনলে ঠকতে হবে, লাল চৌক এ যান। কিন্তু আমাদের কিনে আনা পশমিনা শালগুলো কিন্তু পুনে বা কাশ্মীরের ঠান্ডাতেও ব্যবহার করেছি আমরা আর দারুন গরম হয়ে তাতে। তাই শালগুলো বেশ ভালোই কেনা হয়েছিল। তবে শাড়ি গুলো পরে মনে হয়। না কিনলেও হতো, খুব বেশি অভিনব কিছু ছিল না। তবে যদি সময়ে থাকে তাহলে নিশ্চই লাল চৌক এ যাবেন কেনাকাটার জন্য। বা কাশ্মীর এম্পোরিয়াম থেকেও কিনতে পারেন। আচ্ছা এই কেনা কাটির সময়ে আমি দোকানিকে জিজ্ঞেস করি কোনো ওয়াশরুম পাওয়া যাবে কিনা। উনি আমাকে নিজেদের ওয়াশরুম দেখিয়ে দেন দোকানের পেছনে। ওয়াশরুমটাও বেশ পরিষ্কার পরিছন্ন ছিল।
কেনাকাটা শেষে আমরা আবারো চললাম জলের উপর দিয়ে। এখানে বলি ডাল লেকে আপনি যদি কিছু কেনেন তাহলে তার কমিশন পায়ে শিকারা চালকরা। তেমনি যদি কোনো গ্রুপ এসে শিকারা চড়ে তাহলে শিকারা চালকদের থেকে কমিশন পায়ে ড্রাইভাররা। এই কমিশন এর ব্যাপারটা কিন্তু টুর কোম্পানির এক্তিয়ারে পড়ে না। আমরা ভাসতে ভাসতে ডাল লেকের পেছন দিকে চলে এলাম। নানা ধরণের পাখি দেখতে পাবেন ডাল লেকে জুড়ে, যারা পাখি দেখতে ভালোবাসেন তাদের বেশ ভালো লাগবে। সাথে বাইনোকুলার রাখতে পারেন আরো ভালো অভিজ্ঞতার জন্যে। ডাল লেকের উপরে আমরা লোকালদের বাড়িও দেখলাম। এদের সবার কাছে নিজস্ব বোট থাকে পারাপারের জন্য। এই দিকটায় একেবারেই কোনো কোলাহল নেই - প্রচুর সবুজ গাছগাছালি, রকমারি পাখি, নিঃশব্দতা এবং স্নিগ্ধতা। আমরা প্রায় হারিয়েই গেছিলাম এর রূপে। খানিক বাদে দেখলাম এক বুড়ো ভদ্রলোক একটা বাশ দিয়ে তৈরী ঘাটে বসে সামোভারে (সামোভার) চা ঢালছেন - হয়তো নৌকায় করে বিক্রি করার জন্য তৈরী হচ্ছিলেন। আমাদের দেখে ডাকলেন চা খাওয়ার জন্য। জাভেদ ভাই ঘাটের পাশে নিয়ে এলেন শিকারা। বুড়ো ভদ্রলোকটি বললেন কেহবা আছে। তখন বেশ হালকা ঠান্ডা আমেজ ছিল তাই আমরা দু কাপ কেহবা অর্ডার করলাম, শিকারা এ বসেই খাবো। ততক্ষনে দেখি আর একজন বয়স্ক ভদ্রলোক বেরিয়ে এসেছেন। নজর করলাম ওখানে একটা কাশ্মীরি কাঠের ফার্নিচারের দোকান রয়েছে তারি মালিক বেরিয়ে এসেছেন আমাদের দেখে। উনি বার বার ডাকতে লাগলেন দোকান দেখে যেতে। আমি যেতে চাইছিলাম না প্রথমে কিন্তু উনি এতো জোরাজুরি করলেন যে শেষমেশ গেলাম। মা বসে রইলো শিকারাতেই। দোকানে ঢুকতেই চমক - এতো সুন্দর সুন্দর কাঠের কাজ যে ভাবা যায় না। ছোট বড় নানা সাইজের ফার্নিচার, ঘর সাজানোর জিনিস। কিছু কিছু এতো রাজকীয় যে তাক লেগে যায়। তাদের দামও সেরকমই আকাশছোয়া। এক একটা করে জিনিস দেখতে লাগলেন উনি। একটা ছোট কাঠের বাক্স বের করে আনলেন বললেন এর ঢাকনা খোলার মেকানিসম যদি আমি বার করতে পারি তাহলে পুরস্কার দেবেন। আমি কৌতূহল বশে অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুতেই খোলার রাস্তা পেলাম না। শেষে উনি একটা গুপ্ত লক দেখালেন পাশে যেটা কিনা ডিসাইন এর মতোই দেখতে , সেটা টিপতেই চিচিং ফাঁক ! আরো বেশ খানিক্ষন কাটিয়ে বেরিয়ে এলাম। খারাপ লাগছিলো ভেবে যে কিছু কিনলাম না, কিন্তু যা দাম তাতে রীতিমতো বড়োলোক হতে হবে বা আলাদা বাজেট নিয়েই আসতে হবে কিনতে হলে। শিকারা এ ফিরে মনে পড়লো কাহবার কথা। মা শেষ করে ফেলেছে, আমারটা বসে বসে ঠান্ডা হচ্ছিলো। কিন্তু সেই আধ ঠান্ডা কেহবারো যা স্বাদ ছিল তা আমি কিন্তু আর কোনো কেহবাএ পাইনি আর কোনো দিন। ছোট ছোট করে কাটা নানান ড্রাই ফ্র্রুটস, শুকনো গোলাপের পাপড়ি, মধু আরো নানান জিনিস দিয়ে তৈরী সেই দারুন কেহবা মনে দাগ কেটে গেলো। সেই বুড়ো ভদলোককে আর দেখিনি দ্বিতীয়বার যখন গেছিলাম, ওনার কোনো দোকান ছিল না তাই জানিও না কোথায় পাওয়া যাবে তাঁকে। কিন্তু স্মৃতির মনিকোঠায় রয়ে গেল এই মুহূর্তটি।
ভাসতে ভাসতে আমরা এসে পড়লাম ফ্লোটিং ভেজেটেশন এর কাছে। এই ভাসমান বাগান বা 'রাদ' ম্যাটেড গাছপালা এবং মাটির মিশ্রনে তৈরী হয়ে আর এর উপরেই সব্জিপাতি বানানো হয়ে। এগুলো দেখতে পলকা হলেও, জাভেদ ভাই এর উপরে চড়ে দেখিয়ে দিলেন এগুলো ডুবছে না তার ভারে। এতো অভিনব সব জিনিস জানতে পারলাম ডাল লেকের উপরে জীবন সম্বন্ধে এই এক ঘন্টার রাইডে যে পুরো অভিজ্ঞতাটা দারুন লাগলো। অবশ্যই পারলে একবার সকালের দিকে শিকারা রাইড করবেন। আমাদের এতো ভালো লেগেছিলো জাভেদ ভাইয়ের ব্যবহার যে আমরা ওনার নম্বর চেয়ে নিলাম, শেষ দিন যেদিন শ্রীনগরে কাটাবো সেদিন আবার শিকারা রাইড করবো ওনার সাথেই জানিয়ে দিলাম। নামার আগে ওনাকে আমরা একশো টাকা দিয়েছিলাম টিপ্ হিসাবে তাতে উনি খুব খুশি হয়েছিলেন।
Near Ghat No 18

Floating through backwaters of Dal

Stopping for shopping

Checking out the Shawls

Floating around

4+ bedroom houseboat

Wood Furniture shop



Birds of Dal

Vegetation on the Dal Lake


Flower shop in a boat




ট্রাফিক পুলিশের সাথে ঝামেলা
প্রায় ১১:৩০ বেজে গেছিলো যখন আমরা পার্কিং থেকে বেরোলাম। সব জেনে শুনেও বেশ দেরিতেই শুরু হচ্ছিলো যাত্রা। খুরশিদ ভাই কিন্তু তবুও কোনো বিরক্তি দেখাননি দেরি নিয়ে। ২ মিনিটও হয়নি আমরা পার্কিং ছেড়ে বেরিয়েছি, এর মধ্যেই দেখি সামনে ট্রাফিক পুলিশ - তারা হাত নাড়িয়ে থামতে বললো। প্রথমে খুরশিদ ভাই গাড়ির মধ্যে থেকেই কথা বলছিলো কাশ্মীরীতে কিন্তু ওরা নেমে আসতে বললো। আমি সাইড মিরর এ দেখতে পাচ্ছিলাম কিছু কথা কাটাকাটি হচ্ছে - কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না। প্রায় মিনিট পাঁচেক কেটে গেল। তারপর খুরশিদ ভাই চিন্তিত মুখে এসে গাড়ির পেপার নিয়ে ফের গেলেন ওদের কাছে। আরো মিনিট দশেক পর ফিরে এলেন - বললেন যে পেপার নিয়ে কোনো ইসু পাইনি তাই, ইউনিফর্ম কেন পরে নেই সেই নিয়ে ৫৫০ টাকা ফাইন করেছে। তার মানে দেশের যেকোনো জায়গাই হোক না কেন এই ইচ্ছেমতো ফাইন ব্যাপারটা হয়েই থাকে।
কাশ্মীরি চেরি
যাইহোক আরো বেশ কিছুটা দেরি হয়ে গেল এই পুলিশি চক্করে। এবার জোরদার গাড়ি ছোটালেন খুরশিদ ভাই। শ্রীনগর থেকে বেরোনোর মুখে আমরা একটা ফলের দোকান দেখতে পেয়ে থামলাম। টুকটুকে লাল চেরির সম্ভার নিয়ে বসে আছে দোকানি। দূর থেকে দেখতে ভারী লোভনীয় লাগছিলো। মা গিয়ে বেছে নিয়ে এলো একটা বাক্স - এক বাক্সে ৫০০ গ্রাম চেরি দাম নিলো ২০০ টাকা। পুনেতে এর থেকে অনেক বেশি দামে পাওয়া যেত সেই সময়ে তাই এইটা বেশ সস্তায় মনে হলো। ফল যদি একটু নুন ছড়িয়ে খাওয়া যায় তাহলে আরো ভালো লাগে। আমরা এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট থেকে যা যা জিনিস জোগাড় করে এনেছিলাম খাবারের মধ্যে তার মধ্যে দু প্যাকেট নুন ও ছিল। অল্প করে সেই নুন ছড়িয়ে চেরি গুলো খেতে জাস্ট অসাধারণ লাগছিলো।
পথচলা শুরু
আমাদের পুরো ট্রিপের মধ্যে আজকের দিনের ট্রাভেলটা সবচেয়ে লম্বা। শ্রীনগর থেকে গুৱেজ প্রায় ১৪০ কিমি, আমরা বান্দিপোরা নামক জায়গার উপর দিয়ে যাবো যেটা এই রুট এর একটা বড় শহর। যারা শেয়ারিং গাড়িতে গুৱেজ যান, তারা অনেকসময় এই বান্দিপোরা এ রাত কাটান কারণ এখানে বাজেট স্টে এর অপসন আছে। আমাদের রুটটা এরকম ছিল :
শ্রীনগর - সাদিপুরা - সুম্বাল - নাসাবাল - সাফাপরা - গামরু - বান্দিপোরা - মাঁড়িগাম - রাজদান পাস - কাজলবান - দাওয়ার ( গুৱেজ )
৭-৮ ঘন্টার ব্যাপার - ডিপেন্ড করছে আপনি কতবার থামছেন ( বহুবার থামতে ইচ্ছে করবে যেহেতু ভিউস এতো সুন্দর !), চেকপোস্টে কতক্ষন লাগছে , ওয়েদার কেমন ইত্যাদি। তাই অবশই ১০ তার মধ্যে বেরোনো উচিত শ্রীনগর থেকে কিন্তু আমাদের প্রায় ১২ টা বেজে গেছিলো শিকারা আর ট্রাফিক পুলিশের জন্য। শ্রীনগর থেকে আমরা ভালোই ওয়েদার পেয়েছিলাম - রাস্তায় বেশ ভালো আর তখন এই রুট এ টুরিস্ট গাড়িও কম যেত তাই বেশ মনোরম লাগছিলো। রাস্তায় অনেক চাষের জমিও দেখলাম। আমরা দেখতে দেখতে সুম্বাল পৌঁছে গেলাম। খুরশিদ ভাই জোরে চালাচ্ছিলেন ঠিকই কিন্তু দারুন কন্ট্রোল ওনার, খুব ভালো স্মুথ চালান তাই কোনো অসুবিধে হচ্ছিলো না। এখন থেকে মানাসবল লেক কাছে হলেও একটা ডি-টুর নিতে হয়ে তাই আমরা সেদিকে না গিয়ে এগিয়ে চললাম।
দুপুরের খাওয়া দাওয়া
বেশ অনেকক্ষন চলার পর খিদে পাচ্ছিলো, সেই কখন সকালে ব্রেকফাস্ট করা। খুরশিদ ভাইকে বললাম কোথাও দাঁড়াতে। আমরা সাফাপোর পৌঁছে একটু ভদ্রস্থ দেখতে রেস্টুরেন্ট খুঁজতে লাগলাম। এই দুদিনে আমাদের খাবার এক্সপেরিয়েন্স খুব একটা ভালো হয়নি - তাই এক্সপেকটেশন খুব একটা ছিল না - পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হলেই চলে যাবে। প্রধান চৌক এর উল্টো দিকে একটা রেস্টুরেন্ট এ ঢুকলাম - নাম "তাজ রেস্টুরেন্ট" । লাঞ্চের জন্য বেশি টাইম দেওয়া যাবে না কারণ আমাদের সব কিছুই লেট চলছিল।
বাকি ছোট খাটো কাশ্মীরি রেস্টুরেন্ট এর মতো এখানেও তুজ বা কাবাব মারিনাতে করে বাইরে কাবাব স্টেশন এ ঝোলানো রয়েছে, সেখানেই গ্রিল করে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়ে। বসার জায়গা ভেতরে। ছোট কিন্তু পরিষ্কার জায়গা। মেনুতে অনেক কিছু ছিল কিন্তু আমাদের চাই এমন কিছু যা ঝটপট পাওয়া যাবে - সেই হিসাবে আমরা তাওয়া নান আর আমার জন্য মটন কান্তি আর মায়ের জন্য চিকেন কান্তি নিলাম। এই কান্তি জিনিষটা গতকাল থেকেই মেনু তে দেখছিলাম - তাই জিনিষটা কি ট্রাই করার উদ্দেশেই অর্ডার দিয়ে দিলাম। আরো একটা ইন্টারেষ্টিং জিনিস বুঝতে পারলাম - আমার আগে ধারণা ছিল যে ওয়াজওয়ান ( Wazwan) শুধু মাত্র বড় বড় দোকানেই পাওয়া যায় যেহেতু ওতে অনেক গুলো আইটেম থাকে, কিন্তু কাশ্মীর এসে বুঝলাম - ছোট বড় সব রেস্তোরাঁতেই কম বেশি নম্বরের ওয়াজওয়ান ডিশ পাওয়া যায়। তবে ব্যাপারটা হল যে ভালো রেস্তোরাঁতে দাম হিসাবে কোয়ালিটি ভালো পাবেন।
আমরা অনেকক্ষন হল রাস্তায় ছিলাম তাই এবারে ওয়াশরুম যাওয়ার দরকার ছিল। রেস্তোরাটা দেখে তো মনে হচ্ছিলোনা যে ওয়াশরুম আছে তবে আমি ডেস্কে যে বসে ছিলেন সেই ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম। উনি বললেন এখানে নেই বাইরে কোথাও হতে পারে। একটু হতাশ হলাম, কিন্তু সেই মুহূর্তে আমাদের অর্ডার যে কমবয়সী ছেলেটা নিচ্ছিলো সে এসে বললো তার সাথে ভেতরে আসতে। আমি একটু অবাক হলাম, কিন্তু তবুও তাকে অনুসরণ করে এগিয়ে গেলাম। রেস্তোরার ভেতর দিয়ে আমরা চলে গেলাম একেবারে পেছনে - পর্দা সরিয়ে ঢুকে মনে হল কারো ঘরের উঠোনে চলে এসেছি। খুব একটা ভুল ভাবিনি - ছেলেটি জানালো যে এটা তার বাড়ির ওয়াশরুম। এইরকম অপ্রত্যাশিত অতিথেয়তা সত্যি মন ছুঁয়ে গেল। আমার মনে হয়ে যেহেতু আমরা দুজন মহিলা ছিলাম তাই বারে বারে এখানকার লোকেদের থেকে সাহায্য আর ভালো ব্যবহার পেয়েছি। ওয়াশরুম বেশ পরিষ্কার পরিছন্ন। আমার পর মা কেও আমি রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে এলাম। বেশ অনেকক্ষন কেটে গেছে দেখি মা আর আসে না - আমি ভাবছি যে যাবো নাকি দেখতে কি হল তখনি দেখি পর্দা সরিয়ে মা বেরিয়ে আসছে কথা বলতে বলতে , পেছনে এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। উনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। টেবিলে ফিরে এসে মা জানায় যে এক মুসলিম মহিলার সাথে আলাপ হয়ে ভেতরে, যে ছেলেটি আমাদের ভেতরে নিয়ে গেছিলো তার মা। উনি নাকি বাঙালি, কিন্তু কাশ্মীরি কে বিয়ে করে প্রায় ২০ বছরের ওপরে বাংলার বাইরে। আমাদের বাংলাএ কথা বলতে শুনে উনি বেরিয়ে এসেছিলেন। তারপর নাকি ওদের অনেক গল্প হচ্ছিলো তাই এতক্ষন লাগলো। তার ৩ ছেলে মিলে এই হোটেলটা নাকি গতবছরই খুলেছে। এত হাজার মাইল দূরে এসে এক বাঙালি মহিলার সাথে এভাবে দেখা হবে ভাবিনি। এইজন্যই বলে ঘুরতে গেলে এত রকম অভিজ্ঞতা হয়ে যা ঘরে বসে কোনোদিন সম্ভব নয়।
ততক্ষনে আমাদের খাবার হাজির - খাবারের কোয়ান্টিটি দেখে আমাদের চোখ কপালে। এত্ত কে খাবে? কান্তি বুঝলাম চিলি চিকেনের কাশ্মীরি ভার্সন। ম্যারিনেটেড বোনলেস মাংসের টুকরো ব্যাটারে ডুবিয়ে ফ্রাই করা তারপর পেঁয়াজ, ক্যাপসিকাম, লঙ্কা দিয়ে ষ্টার ফ্রাই। খেতে মোটামুটি ভালোই লাগলো কিন্তু এতটা খেতে পারলাম না তাই বাকিটা প্যাক করিয়ে নিলাম, রাস্তায় কুকুর দেখলে পরে দিয়ে দেয়া যাবে যাতে খাবারটা নষ্ট না হয়ে। পরে রাস্তায় একটা কুকুর পেয়েও গেছিলাম যাকে সেই কান্তি আর আগের দিনের ফ্লাইট থেকে আনা দই খাওয়ানো হয়ে।

উলার (wular) লেকের দেখা
পেটপুজো করে আমরা এগিয়ে চললাম। কিছুদূর গিয়েই দূর থেকে একটা জলরাশি দেখতে পাওয়া গেল যেটা আস্তে আস্তে বড় হতে থাকল। দেখতে দেখতে একটা বিশাল লেক পরিণত হল সেটা। খুরশিদ ভাই জানালেন এটা উলার লেক।
উলার লেক বা কাশ্মীরি ভাষায় ওলার লেক দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম মিঠা পানির হ্রদগুলির মধ্যে একটি। আনুমানিক 189 বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এবং বান্দিপোরা আর বারামুল্লা জেলার মধ্যে অবস্থিত। উলার হ্রদ কাশ্মীর উপত্যকায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের চিরন্তন প্রতীক। পর্যটনের জন্য ধীরে ধীরে অনেক কিছু গড়ে উঠছে এই লেকটিকে ঘিরে। ২০২২ এ অত কিছু ছিল না কিন্তু রিসেন্টলি সরকার এর চারপাশটাকে অনেক ডেভেলপ করছে ট্যুরিজম স্পট হিসাবে, সম্প্রতি উলার ফেস্টিভ্যাল ও আয়োজিত হয়েছে। এই হ্রদে ট্রাউট, কার্প এবং ক্যাটফিশ সহ বিভিন্ন ধরণের মাছ পাওয়া যায়। এখানে নাকি এখন বোটিং, ওয়াটার স্পোর্টস এবং ওয়াটার স্কিইং করা যায়। এছাড়া যাঁরা পাখি দেখতে ও ফটোগ্রাফির শখ রাখেন তারা এখানে পাবেন - ইউরোপীয় চড়ুই, ব্ল্য়াক-ইয়ারড কাইট, ছোট আকৃতির ঈগল, রক ডোভ, আলপাইন সুইফ্ট, হিমালয়ান কাঠঠোকরা ও আরও অজানা প্রকৃতির পাখি।
২-৩ মিনিটের জন্য দাঁড়িয়ে আমি কিছু ছবি তুললাম তারপর আমরা লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে এগিয়ে চললাম বান্দিপোরার দিকে।
Towards Bandipora

Wular Lake

Wular Lake

Entry Check post @ Bandipora

Wular Lake

বান্দিপোরা এ কিছুক্ষন
রেস্তোরার থেকে বেরোনোর পর থেকেই দেখছিলাম খুরশিদ ভাই যেন কার সাথে কাশ্মীরি তে কথা বলে চলেছেন মাঝে মাঝেই। বিশেষ কৌতূহল হয়নি কারণ ভেবেছিলাম কোন চেনা জানার সাথে কথা বলছেন।
উলার লেককে ঘিরে ধরে আছে পর্বত শৃঙ্গ সেই পাহাড়েই আমাদের উঠতে হবে গুরেজ যাওয়ার জন্য। একটা চেকপোস্ট পড়লো বান্দিপোরা ঢুকতে কিন্তু কোনো ডকুমেন্ট আমাদের ওখানে দেখাতে হয়নি। সোজা রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎই খুরশিদ ভাই ডানদিকে বাঁক নিলেন। আমি এবারে জানতে চাইলাম কোথায় যাচ্ছি কিন্তু কোনো পরিষ্কার জবাব পেলাম না। খানিক বাদে গাড়ি থামলো একটা দোতলা বাড়ির সামনে যার নিচের তলাতে দোকান রয়েছে। আবারো জিজ্ঞেস করলাম কেন থামছি এখানে। এবারে খুরশিদ ভাই গাড়ি থেকে নেমে হেসে বললেন "একটু চা খেয়ে নিন "। তখন সবই ধোঁয়াশা লাগছে - হঠাৎ করে চা খাবো কেন ? আমরা নামবো কি নামবো না ভাবছি, ততক্ষনে দেখি দোকানের দরজা ঠেলে একটি কমবয়সী লোক আর ২-৩ জন বাচ্চা বেরিয়ে এসেছে। লোকটি সোজা আমাদের গাড়ির কাছে এসে এক গাল হেঁসে বললো - " আইয়ে থোড়া চায় পি লিজিয়ে ।" আমরা আরো কনফিউস্ড - কি হচ্ছে বুঝছি না। তাও নামলাম কারণ এত সুন্দর করে লোকটি ডাকলো আমাদের। বাচ্চাগুলো ততক্ষনে আমাদের খুব কৌতূহলের সাথে দেখছে - দেখবেই তো আমরা একেবারেই ওদের মতো লাল টুকটুকে দেখতে নই - ভাবছে হয়তো এই কালো কালো বিজাতীয় প্রাণীগুলি কারা ! দোকানের ভেতরে ঢুকতেই চমক - জানলার পাশ দিয়ে একটা টেবিলে এর উপরে সার দিয়ে আচারের বাক্স রাখা। সে কতরকমের যে আচার - তার মধ্যে অনেকগুলো আমি প্রথমবার দেখছিলাম। ব্যাপারটা বোধগম্য হল যখন জানতে পারলাম যে এই দোকানের মালিক ( যিনি আমাদের চা এর ইনভিটেশন দিয়ে নিয়ে এলেন ভেতরে ) রিজু ভাই আসলে গুরেজে যার হোটেলে থাকবো তার ভাই। খুরশিদ ভাইকে ইনিই কল করছিলেন বার বার। যেহেতু গুরেজ তখনো বেশ প্রত্যন্ত গ্রাম ছিল তাই অনেকসময় বান্দিপোরা থেকে কেউ আসলে তাদের সাথে কিছু কিছু জিনিস নিয়ে আসার অনুরোধ করা হতো। এখানেও সেই ব্যাপার - ডিম, আলু, আরো কি সব জিনিস দেখলাম খুরশিদ ভাই ডিক্কিতে ভরে নিলেন।
এর ফাঁকে আমরা সুযোগ পেয়ে গেলাম সেই বিখ্যাত কাশ্মীরি মেহেমান নাওয়াজির অভিজ্ঞতা নিতে। রিজু ভাই সদা হাস্যময় - প্রথমেই উনি এক এক করে আচার চেনালেন - ভেজ এবং নন-ভেজ দু ধরণের আচার মজুত - যেমন শিক কাবাবের আচার, রিস্তার (meatball)আচার, ট্রাউট মাছের আচার, কাশ্মীরি লাল লংকার আচার, প্লামের (আলু বোখরা) আচার, আঙুরের আচার, মাটনের আচার, চিকেনের আচার, নাদ্রু আচার, করেলা আচার, লেবুর আচার ইত্যাদি। দোকানের নাম হচ্ছে TR Wholesale মার্ট আর এটা মসজিদ সুলতানিয়া সোনেরওয়ানির কাছে অবস্থিত।
যেহেতু আমরা ওনাদের হোটেলে থাকবো, তাই আমাদের জন্য স্পেশাল ট্রিটমেন্ট - দোকানের ভেতরে বসার অনুমতি, নাহলে খদ্দেরদের বাইরে থেকেই কেনাকাটা করতে হয়ে। বাচ্চাগুলো কিন্তু এখনো দরজার বাইরে থেকে আমাদের দেখে চলেছিল, আমি হাতছানি দিয়ে ডাকতেই ছেলেগুলো লজ্জা পেয়ে পালিয়ে গেল ! কিন্তু একটি মেয়ে ভেতরে এসে দাঁড়ালো - সে একটি পুতুলের মতো দেখতে - আমি ওর অনেক ছবি তুললাম তখন। এরপর চা না খেয়ে আমরা বললাম বরং আইস ক্রিম খাবো - তাই আনা হল আমাদের জন্য। আমি বললাম এই বাচ্চাগুলোকেও আইস ক্রিম খাওয়াবো আমি - তখন রিজু ভাই বললেন ওদের জন্য আলাদা করে স্টিক আইস ক্রিম আনা হচ্ছে। আমরা বেশ অনেকক্ষন জমিয়ে গল্প করলাম - জানলাম রিজু ভাই IS aspirant আর দক্ষ ট্রেকার। দোকানটা উনি সাময়িক ভাবে দেখছেন যতদিন না IS পরীক্ষা ক্লিয়ার হচ্ছে। ওনার বাকি ফ্যামিলি উপরের তলায় থাকেন - বলতে বলতেই ওনার মা আর বোন এসে আমাদের সাথে আলাপ করলেন। এদের এত্ত সুন্দর দেখতে যে সত্যি চোখ ফেরানো মুশকিল! যাওয়ার আগে পরিবারের আরো সদস্যরা আমাদের সাথে দেখা করতে এলেন এবং রিজু ভাই আমাদের অনেকগুলো আচার প্যাক করে দিয়ে দিলেন ফ্রীতেই খেয়ে দেখার জন্য। আমরা যত না করি উনি কিছুতেই শুনলেন না।
আমরা গাড়িতে উঠলাম আর তার সাথেই ওনাদের ফ্যামিলির দুই বৃদ্ধা মহিলাও উঠলেন। ওনাদের একটু আগে ড্রপ করে দিতে হবে। এঁরা গ্রামের মহিলা তবুও ওদের কথাবার্তায় এমন বুদ্ধিমত্তার ছাপ রয়েছে যে মনে হবে যেন কত শিক্ষিত।
বান্দিপোরার লাইফলাইন হল মধুমতি নামের একটি নদী - হারমুখ পাহাড়ের গাংসার নামের লেকের থেকে এর উৎপত্তি - নিচে নেমে অরিন নাল্লাহ আর মধুমতি নামের দুই নদীতে বিভক্ত হয়ে যায়। 'সাই ব্রিজ' নামক ৫৫ মিটারের এক ব্রিজ বানানো হয়েছে মধুমতির উপরে পারাপারের জন্য যেটা পার করে আমরা বান্দিপোরা-গুৱেজ রোড ধরে এগিয়ে চললাম। এটা গুরুত্বপূর্ণ এই জন্যে কারণ বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন এটা তৈরী করে গুরেজের মতো সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোকে মেনল্যান্ড এর সাথে যোগ করার জন্য। এর মধ্যে হোটেল থেকে ফোন এলো - শেফ জানতে চাইছেন রাতে আমরা কি খাবো - ভেজ নন-ভেজ দুটোই থাকবে। ভেজ নিয়ে চিন্তা নেই, নন ভেজে আমি ট্রাউট মাছ ভাজা করে রাখতে বললাম।
এক রাস্তার বাঁকে এসে আমাদের গাড়ির দুই মহিলা নেমে গেলেন ওনাদের ঘরের সামনে - আমাদের অনেক বার করে ডাকলেন ওনাদের ঘরে আসতে, চা খেতে - কিন্তু সময়ে নেই তাই না বলে ওনাদের বিদায়ে জানালাম। পরে বুঝেছিলাম, এই চা খেতে ডাকা টা কাশ্মীরি কালচারে খুব কমন। ওনারা মোটামুটি সবসময়েই শুধু 'ঘরে আসুন' বলার জায়গায় 'আসুন চা খেয়ে যান' এইভাবেই ইনভাইট করেন নিজেদের বাড়িতে। তখন টুরিস্ট এত কমন ব্যাপার ছিল না এই রুটে তাই আমরা এই ধরণের ইনভাইট অনেক বার পেয়েছি অনেকের কাছ থেকে - আর ওরা কিন্তু শুধু বলার জন্য নয়, সত্যি করেই মন থেকে আমন্ত্রণ জানান আপনাকে টা সে গরিব হোক বা বিত্তবান।






পাকদন্ডী বেয়ে এগিয়ে চলা
বান্দিপোরা থেকে গুরেজ উপত্যকার দূরত্ব প্রায় ৮৬ কিলোমিটার। আমরা ধীরে ধীরে চড়াই পথ ধরে ওঠা শুরু করেছিলাম। বান্দিপোড়াকে পেছনে রেখে যত উপরের দিকে উঠি, দৃশ্য গুলো যেন আরো মনোরম হয়ে যাচ্ছিলো। ঘন পাইন বনের মধ্যে আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলেছে। বাঁক নিতেই দূরে দেখা যাচ্ছে উলার লেক আর তার উপরে ভেসে থাকা পুঞ্জ পুঞ্জ সাদা তুলোর মতো মেঘ। হাওয়া ধীরে ধীরে ঠান্ডা হচ্ছিলো। আরো কিছুটা যেতেই লক্ষ্য করলাম পাহাড়ের অনেকটা উপরে কালো মেঘের আনাগোনা, তখন আমাদের আসে পাশে রোদ রয়েছে। খুরশিদ ভাই জানালেন ঐসব পাহাড় পেরিয়েই আমাদের যেতে হবে।
আসে পাশের দৃশ্য যে কতটা সুন্দর টা লিখে বোঝানো যাবে না - চোখ যা দেখে তা ক্যামেরাও দেখতে পারে না। রাস্তা কিন্তু তখন বেশ মসৃন, যেমন শুনেছিলাম যে রাস্তা খুব খারাপ তেমন কিছুই নজরে তখন পড়ছে না। যেহেতু এই রুটে আর্মির গাড়ি চলে তাই তারাই রাস্তা মেরামতির কাজ করে থাকে সময়মত। যেতে যেতে এক জায়গায় জ্যামে আটকে গেলাম - পাল পাল ভেড়া আর ছাগল রাস্তা পার হচ্ছে সাথে মেষপালকরাও আছে। এত কিউট জ্যামে পড়লে এমনিতেই মন ভালো হয়ে যায়। দেখলাম কিছু বাচ্চা ভেড়া যাদের পায়ে পট্টি বাধা তাদেরকে আবার কোলে করে নিয়ে যাচ্ছে মেষপালকরা। বেচারাদের পায়ে হয়তো লেগেছে তাই এই ব্যবস্থা। এই মেষপালকরা নাকি গরমের সময়ে এভাবেই জায়গায় জায়াগায় ঘুরে বেড়ান আর সেখানেই তাবু খাটিয়ে কিছু দিন কাটিয়ে আবার নতুন জায়গায় চলে যান - এটাই তাদের জীবন।
ভেড়াদের যানজট পেরিয়ে আমরা আবারো এগোলাম। আকাশের মুখ সামান্য ভার তখন। হালকা হালকা ঠান্ডা হাওয়ায় বইছে। দূরের পাহাড়গুলো আরো ঘন সবুজ দেখাচ্ছে মেঘের জন্যে। দেখতে দেখতে আমরা ত্রাগবাল পৌঁছে গেলাম। বেশ কয়েকটা হেয়ারপিন বেন্ডের পর একটু সমতল জায়গায় ২-৩ তে খাওয়ার দোকান - সামান্য কিছু চা / স্নাক্স এর জন্য চাইলে থামতে পারেন কারণ এই জায়গাটা খুব সুন্দর। তবে আকাশের অবস্থা দেখে আমরা আর দাঁড়ানোর সাহস করলাম না, তখন অনেকটাই রাস্তা বাকি।
প্রথম চেকপোস্ট (Tragbal Check post) আর মাস্তানির সাথে দেখা
পুরো কাশ্মীরেই জায়গায় জায়গায় আর্মি চেকপোস্ট রয়েছে কিন্তু এই রুটে খুব ঘন ঘন ( ৬-৭ ) চেকপোস্ট পাবেন রাজদান পাস শুরু হওয়ার আগে থেকে। এর মধ্যে শুধু কয়েকটা চেক পোস্টেই ডকুমেন্ট (আধার কার্ড) দেখিয়ে এন্ট্রি করতে হবে। এই চেকপোস্ট গুলোতে কিছু code of conduct মানতে হয়ে কিন্তু সবাইকেই - তা সে লোকাল হোক বা টুরিস্ট। আপনার ড্রাইভার আপনাদের আগে থেকেই জানিয়ে দেবে যে কোনোরকমের ফোটোগ্রাফি/ ভিডিওগ্রাফি করা মানা এখানে। আমি ডিটেলস নিচে টিপস এ বলে দিয়েছি।
প্রথম যে চেকপোস্টটা পড়বে টার নাম ত্রাগবাল চেকপোস্ট - সেটার বেশ খানিকটা দূরে গাড়ি দাঁড় করতে হয়ে। বেশিরভাগ টুরিস্ট বা লোকালদের গাড়ি আরো অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে , আমরা অনেক লেট যাচ্ছিলাম তাই আমাদের গাড়ি ছাড়া সে মুহূর্তে আর কেউ ছিল না। খুরশীদ ভাই আমাদের দুজনেরই আধার কার্ড নিয়ে নেমে গেলেন এন্ট্রি করতে সামনে একটা ছোট ছাউনি দেয়া অফিসার মধ্যে। আমাদের গাড়ি থেকে নামতে মানা করে গেছিলেন খুরশিদ ভাই, সেই মতো গাড়িতেই বসে আসে পাশের দৃশ্য দেখছিলাম আমরা। এই এন্ট্রি করানোর কারণ হচ্ছে ট্র্যাক রাখা কতজন টুরিস্ট এলো গেল - যদি ঠিক সময়ে এক্সিট না হয়ে তাহলে আর্মি খোঁজ করা শুরু করবে আর সেই হিসাবে অ্যাকশন নেবে। কেউ যদি হারিয়ে যায় বা কোনো দুর্ঘটনায় পড়ে তাহলে এই এন্ট্রির মাধ্যমেই ওরা বুঝতে পারবে।
তার মধ্যে দেখি এক কম বয়সী আর্মিম্যান আমাদের গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। রোজকার জীবনে আর্মিম্যানদের দেখে আমরা অভস্ত নই তাই তাকে এগিয়ে আসতে দেখে একটু নার্ভাস তো লাগছিলোই। কিন্তু যা দেখে আমার চোখ আটকে গেছিলো সেটা হল ওর সাথে হেঁটে আসা একটা বিশাল বড় সাইজের জার্মান শেফার্ড কুকুর। তার সাথে আবার একটি ছোট নেড়ি কুকুরও পেছন পেছন আসছিল। আর্মিম্যান কাছে এসে জানতে চান আমরা কথা থেকে আসছি আর শুধু কি আমরা দুজন মাত্র মহিলা রয়েছি ? আমি গুছিয়ে উত্তর দিলাম আর উনি সেটা মন দিয়ে শুনলেন। ততোক্ষণেও আর কোনো গাড়ি আসেনি শুধুমাত্র আমরাই ওখানে ছিলাম। আমি কিন্তু তখনো কুকুরটাকেই দেখে চলেছি। তারপর ওনাকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম যে ওর কুকুরটাকে আদর করতে পারি কিনা। ভেবেছিলাম হয়তো বকা দেবে কিন্তু উনি রাজি হয়ে গেলেন। আমি তো মহা খুশি - গাড়ি থেকে নেমে এলাম সঙ্গে সঙ্গেই। জানতে চাইলাম এর নাম কি - আর্মিম্যান বললেন মাস্তানি। যেমন রাজকীয় নাম তেমনি রাজকীয় অঙ্গভঙ্গি। মাস্তানির বয়েস ভালোই হয়েছে আর সে এই আর্মিম্যানের নেওটা বোঝাই যাচ্ছিলো। আমি আলতো করে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম - দেখি কোনো রিঅ্যাকশন দিলো না - শান্ত হয়েই বসে রইলো।
আরো আদর করার ইচ্ছে ছিল কিন্তু দেখলাম খুরশিদ ভাই ফিরছে তাই আর্মিম্যানকে ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লাম আবার। ততক্ষনে একটু আধটু ঝোড়ো হাওয়া বইছে - আকাশটা আরো অন্ধকার করে আসছে - বৃষ্টি যে নামবে শিগগির তা বুঝতেই পারছিলাম। আর্মিম্যানটি যেতে যেতে আমাদের বললেন - "আমরা আমাদের মা , বৌ, বোনদের ছেড়ে এত দূরে এইজন্যেই আছি যাতে এখন দিয়ে যে মা, বোনেরা ট্রাভেল করছেন তাদের সুরক্ষিত রাখতে পারি " - কথাটা একেবারে হৃদয় ছুঁয়ে গেল। দেশের প্রতি কর্তব্য আর ফ্যামিলির থেকে দূরে থাকার কষ্ট দুটোকে নিয়েই এনাদের রোজকার জীবন। উনি খুরশিদ ভাইকে বললেন - "যাও সাবধানে তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছাও, বৃষ্টি নামবে"। আমরা আবারো একবার কৃতজ্ঞতা পূর্ণ ধন্যবাদ জানিয়ে এগোলাম - মাস্তানির সাথে ফেরার সময়ে আবার দেখা হবে এই ভেবে।

শ্বেত শুভ্র রাজদান টপ (Razdan Top)
আকাশের চেহারাটা আস্তে আস্তে আরো রাগী হচ্ছিলো। রাস্তার উল্টোদিকে ডান পাশে আমরা একটা পীর বাবার মন্দির দেখতে পেলাম - ঠিক হল ফেরার দিন ওখানে থামা হবে। খুরশিদ ভাই বেশ জোরেই গাড়ি চালাচ্ছিলেন আর যেহেতু রাস্তা ভালো তাই বিশেষ অসুবিধেও হচ্ছিলো না। উনি চাইছিলেন দিনের শেষ আলোটুকু থাকতে থাকতে ঘাট এরিয়া তা পার করে যাওয়া। সত্যি বলতে কি ততক্ষনে আমার একটু চিন্তা যে হচ্ছিলো না তা নয়।
রাজদান পাসে ঢোকার মুখে আর একটা চেকপোস্ট পেলাম - কিন্তু সেখানে সামান্য কিছু জিজ্ঞেসাবাদ করে আর আগের চেকপোস্ট থেকে দেয়া স্লিপ দেখেই আমাদের ছেড়ে দিলো - গাড়ি থেকে আর নামতে হয়নি। হয়তো ওয়েদার খারাপ হচ্ছিলো বলেই ওরা আর থামালো না আমাদের গাড়ির মধ্যে দুজন মহিলা দেখে।
রাজদান পাস উত্তর কাশ্মীরের বান্দিপোরা এবং গুরেজ উপত্যকার মধ্যে সর্বোচ্চ পয়েন্ট। এটি 11,624 ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এবং গুরেজ উপত্যকাকে রাজ্যের বাকি অংশের সাথে সংযুক্ত করেছে। এটি এক সময় কাশ্মীর এবং মধ্য এশিয়ার মধ্যে সিল্ক রুটের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল, কিন্তু আজ এটি খুব কমই ব্যবহৃত হয়। প্রকৃতপক্ষে, নিয়ন্ত্রণ রেখা (LOC) এর নিকটবর্তী হওয়ার কারণে এটি কিছু বছর আগে পর্যন্ত পর্যটকদের জন্য খোলা ছিল না। ভারি তুষারপাতের কারণে সাধারণত অক্টোবর নভেম্বর থেকেই ৫-৬ মাসের জন্য বন্ধ হয়ে যায় গুরেজগামী এই প্রধান সড়ক।
রাজদান পাস এ পৌঁছাতেই বাঁধানো রাস্তা পেলাম। তাপমাত্রা যেন হুঁ হুঁ করে নামতে লাগলো যত আমরা এগোচ্ছি। মেঘের দেয়াল আরো কাছে ঘনিয়ে এলো এবং ধিরে ধিরে দূর পাহাড়ের দৃশ বদলে গেল - গাড় সবুজ থেকে শ্বেত শুভ্র বরফের ঝিকমিক। রাস্তার একপাশে তখনো জমাট বাধা পুরোনো বরফ যা একটু কালচে হয়ে গেছে - ২ সপ্তাহ আগে পর্যন্ত দেখেছিলাম ফটোতে বিশাল বরফের চাই। এখন গলতে গলতে এইটুকু বাকি। একটা জায়গায় এসে খুরশিদ ভাই গাড়ি থামিয়ে বললো বাইরে নামতে পারেন। মা আর আমি নেমে পড়লাম - নামতেই হাড় হিম করা ঠান্ডা হওয়ার ঝলক - গাড়ির ভেতরে থাকতে অত বুঝিনি। দু পা এগোতেই দেখলাম অন্য পাশে পাহাড় নেমে গেছে এক্কেবারে সোজা হাজারফুট নীচে। সামনে বাকি পাহাড়ের 360-ডিগ্রি দৃশ্য আপনাকে হঠাৎ করেই যেন সেই Yeh Jawani Hai Deewani র ছবির সেই তুষারাবৃত পাহাড়ের দৃশ্যে পৌঁছে দায়ে যেখানে নায়না আর বানি দাঁড়িয়ে ছিল। জায়গাটার এমনি বৈশিষ্ট্য যে রোমান্টিক আর আধ্যাত্মিক দু ধরণেরই ফিলিং একসাথে হবে। আরো কিছুক্ষন দাঁড়ানো যেত কিন্তু দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছিলো ঠান্ডা হাওয়ায়, আমরা একটু সেই কালচে বরফ তুলে দেখলাম - মনে হল হাতটা একেবারে নিমেষে জমে গেল ! তাড়াতাড়ি গাড়ির ভেতরে গিয়ে ঢুকলাম - খুরশিদ ভাই দেখি হিটার চালিয়ে দিয়েছেন ততক্ষনে। তাড়াতাড়ি জ্যাকেট শাল বার করে গায়ে চড়ালাম আমরা। খুরশিদ ভাই গাড়ি স্টার্ট দিতেই বললেন দেখো বরফ পড়ছে ! আমরা হাঁ করে দেখি সত্যি তাই - ঝিরি ঝিরি বরফপাত হচ্ছে উইন্ডশিল্ডে - সে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।
জানলাম যে ভ্যালি তে বৃষ্টি হলে রাজদান টপ এ বরফ পড়ে। আর একটা ব্যাপার যদি মেঘ না থাকতো তাহলে হারমুখ পিক দেখা যায় রাজদান পাস থেকে, আমরা সামান্য ঝলক পেয়েছিলাম শুধু। বরফপাত কিন্তু শুধু রাজদান পাস পর্যন্ত হয়েই থেমে গেছিলো আর তারপর শুরু হল বৃষ্টি। প্রথমে হালকা বৃষ্টি তারপর রীতিমতো ঝমঝম করে। পুরো রাস্তায় আর একটাও জনমানব নেই শুধু আমরা চলেছি সেই ভয়ঙ্কর বৃষ্টির মধ্যে। এবার মায়ের টেনশন শুরু - দশ মিনিট অন্তর অন্তর খুরশিদ ভাইকে জিজ্ঞেস করছে - আর কত দূর? সেও দেখি একই উত্তর দিয়ে চলেছে সমানে - ব্যাস আর একটু ! বুঝলাম আমাদের ভয় পাওয়াতে চাইছেন না খুরশিদ ভাই যেহেতু তখনো আমাদের বেশ অনেকটা যাওয়ার ছিল।






Razdaan Pass

Razdaan Paas

On way to Raazdan Pass


Cloud Cover near Razdan Paas





কৃষ্ণগঙ্গার প্রথম দর্শন
খানিক বাদে মা ক্লান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করা ছেড়ে দিয়েছিলো। সব জালনা বন্ধ গাড়ির মধ্যে ভ্যাপসা গরম লাগছে। বাইরে এত বৃষ্টি হচ্ছে যে ভিসিবিলিটি ২০-২২ ফিটের মতো হবে। আমার আইডিয়ার নেটওয়ার্ক বান্দিপোরার কিছু পরেই চলে গেছিলো, জিও আসছিল যাচ্ছিলো। প্রে করছিলাম গুরেজে গিয়ে যেন নেটওয়ার্ক পাই।
এরপর আর একটা চেকপয়েন্ট আসে যেখানে খুরশিদ ভাই কে নামতে হয়ে। জায়গাটার পাশ দিয়েই একটা খরস্রোতা নদী বয়ে চলেছিল। ৫-৭ মিনিট লাগলো এন্ট্রি করতে। জানলাম এখন থেকে পাকিস্তানের সীমানা দেখা যায় আকাশ পরিষ্কার থাকলে। ঐটেই শেষ চেকপয়েন্ট ছিল, এরপর কতগুলো পাহাড় পেরোলাম জানি না, অনেকক্ষন পর দেখি পাস দিয়ে একটা বেশ বড় নদী দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টির জন্য ঝাপসা জালনা দিয়ে বিশেষ কিছু ঠাহর হল না কিন্তু বুঝলাম এইটেই হয়তো কৃষ্ণগঙ্গা বা কিষেণগঙ্গা হবে। একটা ড্যাম তৈরী হচ্ছে দেখলাম ( এতদিনে সেটা তৈরী হয়ে গেছে ) দাবারের এক কিমি আগের থেকে।
গুরেজে পদার্পন এবং পাইন ভিউ রিসোর্ট
আমি বুঝতেও পারিনি যে কখন আমরা ব্রিজ পেরিয়ে দাওয়ার ঢুকে পড়েছি। আবার সামনে ভেড়ার জ্যাম আর কিছু ঘর বাড়ি দেখে জিজ্ঞেস করলাম যে আমরা কি পৌঁছে গেছি ? খুরশিদ ভাই জানালেন হ্যাঁ। যেন স্বস্তির নিশ্বাস পড়লো। ওর এক মিনিটের মধ্যেই হোটেলে পৌঁছে গেলাম, তখন ঘড়িতে বাজে বিকেল ৬:৪০। বৃষ্টি তখনো পড়ে চলেছে তবে অনেকটাই হালকা। মজার কথা তখনো কিন্তু আকাশে আলো আছে।
আমাদের হোটেল দাওয়ার থেকে পেশ খানিকটা পেছনে 'ওয়ামপোরা' বলে একটা জায়গায়। এখন থেকে দাওয়ার মার্কেট ৫-৭ মিনিট। হোটেলটা বেশ নিরিবিলি একটা গ্রামে মধ্যে তাই বেশ ভালো লাগলো প্রথম দর্শনে। বাইরে থেকে একটু ছোট মনে হলেও ভেতরটা বেশ সাজানো গোছানো ঘরোয়া। আমাদের রুম দোতলায়। সেই রিজু ভাইয়ের দাদা আর হোটেলের শেফ শাকিল ভাই দুজনেই অভ্যর্থনা করলেন আমাদের। সেদিন শুধু আমরাই গেস্ট ছিলাম। শাকিল ভাই আমাদের ব্যাগপত্তর নিয়ে উপরে পৌঁছে দিলেন। সামনে সামনি দুটো রুম - একটা থেকে হাব্বা খাতুন ( Habba Khatoon) দেখা যাচ্ছিলো আর একটা থেকে অন্য দিকের পাহাড়। আমরা হাব্বা খাতুনের ভিউ ওয়ালা রুমটা নিলাম ( পরে বুঝেছিলাম হোটেলে ঐটাই সবচেয়ে ভালো রুম আর ভিউ )। প্রোপার্টিটা তখন সদ্য হয়েছে তাই সব কিছু ঝাঁ চকচকে। রুম এ অনেক চার্জিং পয়েন্ট যা সবচেয়ে ভালো ব্যাপার।
আমরা একটু ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ততক্ষনে দেখি বৃষ্টি থেমে গেছে। সামনে হাব্বা খাতুনের উপরে পুরু মেঘের চাদর। চারিদিকে এত সবুজ যে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। সামনে একটা লাল ছাদের বাড়ি - আর পাশ দিয়ে কিছু গরু চরে বেড়াচ্ছে। আমি একটা ফটো তুলে হোয়াটসঅ্যাপ স্টেটাস দিতেই দেখি লোকেরা জানতে চাইছে আমি সুইজারল্যান্ড কবে গেলাম ! তাহলেই বুঝতে পারছেন কতটা সুন্দর জায়গা।
Dinning table @ Pine Tree

1st Floor seating area@ Pine Tree

View from our Room - Habba Khatoon covered in clouds after Rain

Habba Khatoon facing Room @ Pine Tree

আশপাশ ঘুরে দেখা / দাবার (Dawar) মার্কেট
তখন হোটেলে পাওয়ার ছিল না কিন্তু এদের ব্যাকআপ আছে তাই মালিক সেটা চালিয়ে দিতে আমরা ফোন গুলো একটু চার্জ করে নিলাম। সাথে সাথে আমাদের চা দেয়া হল - আমরা রুম এর বাইরের কমন এরিয়া এ বসে সামনের পাহাড়ের ভিউ দেখতে দেখতে চা শেষ করলাম। রুমে কোনো টিভি নেই তাই আমরা ঠিক করলাম একটু পায়ে পায়ে বাইরেটা ঘুরে দেখি। তখন বাজে ৭:৪০ কিন্তু আমি আগের কিস্তিতেও বলেছি কাশ্মীরে অনেকক্ষন আলো থাকে তাই বাইরে তখনো আলো ছিল। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর এত্ত সুন্দর লাগছিলো চারপাশটা কি বলবো। পড়ন্ত বিকেলের শেষ আলোয় জায়গাটাকে যেন রূপকথার দেশের মতো দেখাচ্ছিল। একটা শুরু রাস্তা চলে গেছে গ্রামের মধ্যে যেটা আমাদের হোটেলের সামনে দিয়েই গেছে। রাস্তায় কেউ নেই শুধু আমরা দুটি প্রাণী হেঁটে বেড়াচ্ছিলাম। তখন দেখি হোটেলের মালিক আর খুরশিদ ভাই ওই মালিকের গাড়িতে উঠছেন বাজার থেকে কিছু জিনিস কেনার জন্য। আমাদের দেখে খুরশিদ ভাই জিজ্ঞেস করেন আমরা সাথে যাবো কিনা। কিছু না ভেবেই বললাম হ্যাঁ। ছোট্ট গাড়িতে পেছনের সিট এ বসলাম মা আর আমি , সামনে ওরা দুজন। সিট এর মধ্যে জিনিস ঠাসা তারমধ্যেই গুতোগুতি করে বসে পড়লাম।
এই কার রাইডটা এত ইউনিক ছিল যে কি বলবো। ততক্ষনে সন্ধে নেমে গেছে - গুরেজে কিন্তু তখনো তেমন ভাবে স্ট্রিট লাইট ছিল না তাই বেশ অন্ধকার - শুধু গাড়ির হেডলাইটের আলোতে সামনেটা দেখা যাচ্ছে। সেদিন চাঁদ ছিল তাই দূরের গাছগাছালি পাহাড় রুপোলি আলোয় চকচক করছিলো। উঁচুনিচু রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে মনে হচ্ছিলো এ যেন কোনো স্বপ্নরাজ্যে চলে এসেছি। তার সাথেই যোগ হল নদীর আওয়াজ - বেশ জোরে বয়ে চলেছে কৃষ্ণগঙ্গা কিন্তু কিছু দেখা যাচ্ছে না। কয়েক মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম দাওয়ার মার্কেট। দাওয়ার হল কেন্দ্রীয় জনপদ যা গুরেজ উপত্যকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। এখানে একটু মানুষজন দেখা গেল। খুরশিদ ভাইরা চলে গেলেন কেনাকাটা করতে আর আমরা একটু হেঁটে বেড়ানোর জন্য এগিয়ে গেলাম। প্রথমে একটা সুন্দর সুসজ্জিত cafe দেখতে পেলাম। এই গ্রামের মধ্যে এত সুন্দর কাফে যেন মানাচ্ছিলোই না। ঘুরে ঘুরে দেখলাম সবজির দোকান। সব্জিপাতি কম হলেও, কেটে রাখা চিকেন সব দোকানেই ছিল। যেহেতু এত ঠান্ডা তাই হয়তো কেটে রাখা চিকেন খারাপ হয়ে না ওখানে।
বাজার সেরে ফেরার পথ ধরলাম। রাস্তায় একমাত্র পেট্রল পাম্প এ থামলাম। পেট্রল পাম্প এ আলাদা করে কেউ থাকে না , পাশে যে গ্রোসারি দোকান আছে তারি লোকটা এসে ভোরে দিয়ে গেল পেট্রল। এখানকার জীবন যাত্রা যত দেখছি তত অবাক হচ্ছি আর ভাবছি যে শীত কালের সময়ে কত কষ্টেরই না জীবন হয়ে এদের।



Gurez Village

Around Gurez Village

View of Razdan Pass

Cafe in Gurez Market

রাতের ডিনার
যত রাত বাড়ছে তত ঠান্ডাও বাড়ছে। হোটেলে কিন্তু জিওর সিগন্যাল বেশ ভালো পেয়েছিলাম। আমরা রুমে ফিরে প্রথমে বিছানাটা রেডি করে নি। যদিও সবকিছুই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছিল, তবু বাড়ি থেকে আনা বালিশের কভার দিয়ে বালিশ গুলো ঢেকে নিলাম। তারপর মোটা লেপটার যেটুকু মুখের কাছে থাকবে সেইটুকু বেডশীট দিয়ে মুডে নিলাম। রুমে বসে খানিক গল্প করতে করতেই শাকিল ভাই ডাক দিলেন ডিনার এর জন্য। ওয়াশ বেসিন কিন্তু রুমের বাইরে কমন জায়গায়। ঠান্ডা জলে হাত ধুয়ে মাটিতে বসে পড়লাম - আমাদের জন্য ওয়াজবান স্টাইল এ মাটিতেই বসার আয়োজন হয়েছিল সেদিন। এক এক করে খাবার সাজিয়ে দিলেন সামনে শাকিল ভাই। মাশরুম মাটার, ডাল , দু ধরণের চাটনি, ট্রাউট মাছ ভাজা, স্যালাড আর সাদা ভাত। সারাদিনের জার্নি তে ভালোই খিদে পেয়েছিলো, আমরা চটপট সব শেষ করে ফেললাম। তবে ঠান্ডাটা ওখানে এত বেশি যে খাবার তাড়াতাড়ি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিলো।
Dinner @ Pine Tree Resort

দিনের শেষ
খেয়েদেয়ে রুমে ফিরে এসে বুঝলাম বাইরে আবার বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। রুমটা দারুন সুন্দর গরম ছিল কিন্তু আমাদের। খুরশিদ ভাই পাশের একটা বাড়িতে ( একই জায়গার মধ্যে ) থাকবে। কাশ্মীরে এইটা ভালো যে ওরা ড্রাইভারদেরও থাকার জায়গা দেয়।
আমরা সেদিন এত ক্লান্ত ছিলাম যে কখন বৃষ্টির আওয়াজ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতেও পারলাম না।
পরের কিস্তিতে থাকবে সকাল বেলায় গুরেজ গ্রামটা ঘুরে দেখা, গ্রামের লোকজনদের সাথে আলাপ পরিচয় আর ওদের জীবনযাত্রার একটি টুকরো ছবি।
দ্বিতীয় দিন থেকে কিছু টিপস
  • শিকারা রাইড নেবেন ঘাট #১৮ বা তার থেকে কম নম্বরের (#১৭, #১৬ )ঘাট থেকে। এখন থেকে সব আসল পয়েন্টসগুলো ( মীনা বাজার, নেহরু পার্ক ) কাছে তাই বোট রাইডের দাম তুলনামূলক ভাবে কম হবে। আবার যদি চার চিনার যেতে চান তাহলে দূরের ঘাটগুলো থেকে কাছে হবে (#২১ এর পরের গুলো )।
  • শিকারা রাইড দিনের সবসময়েই আলাদা অভিজ্ঞতা দেয়। সকালের রাইডে আপনি অনেক শান্তি অনুভব করবেন যেহেতু হাতেগোনা টুরিস্ট থাকে। সেই সময়টা ব্যাকওয়াটার্স এর অলি গলি দিয়ে ভেসে বেড়াতে দারুনা লাগে এক কাপ গরম গরম কাহওয়ার সাথে । একটু বেলা হয় গেলে জায়গাটা দোকান পাটে জমজমাট হয় ওঠে। আবার পযন্ত বিকেলে ঘুরলে সানসেট এনজয় করতে পারবেন। আর যদি রাতে রাইড নেন তাহলে গোল্ডেন লেক দেখতে পাবেন, আলো ঝলমল মীনা বাজার পাবেন আর পাবেন লেপ কম্বল মুড়ি দিয়ে ডাল লেকের ওপরে ভেসে বেড়ানোর অভিজ্ঞতটা। তাই নিজের ভালোলাগার হিসাবে সময়টা বেছে নেবেন।
  • শিকারা চালকের সাথে ভাব পাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করুন, তাতে ওরা অনেকসময়ে একই ভাড়ায় অতিরিক্ত ৩০ মিনিট যোগ করে দিতে পারে।
  • যেদিন গুরেজ যাবেন সেদিন তাড়াতাড়ি বেরোবেন। যত তাড়াতাড়ি বেরোবেন তত ভাল। চেষ্টা করুন ৮:৩০ এর মধ্যে বেরোনোর তাহলে ৪ টে বা ৪:৩০ নাগাদ পৌঁছে যাবেন গুৱেজ দিনের আলো থাকতে থাকতে। পাহাড়ে অনেক সময়ে বিকেলের দিকে বৃষ্টি হতে পারে তাই তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাওয়াই ভাল। আরো একটা ব্যাপার বেশির ভাগ রাস্তাতেই কিন্তু এখনো ইলেক্ট্রিসিটির ব্যবস্থা হয়নি তাই আলো থাকতে পাহাড়ি রাস্তা কভার করে নেয়া ভাল।
  • এর মধ্যে ৪৫ থেকে ৫০ মিনিটের লাঞ্চ ব্রেক নিতে পারেন
  • লাঞ্চের জন্য চেষ্টা করবেন বান্দিপোরা বা তার আগে স্টপ নিতে। বান্দিপোরা বেশ বড় শহর, ওখানে কিছু ঠিকঠাক খাবার জায়গা পেয়ে যাবেন প্রপার লাঞ্চ করার জন্যে।
  • লাঞ্চ ব্রেকের সময়ে ওয়াশরুম ব্রেকও অবশ্যই নিয়ে নেবেন - বিশেষ করে এটা বলছি মহিলাদের জন্যে। একবার পাহাড় চড়া শুরু হয়ে গেলে বা বান্দিপোরা ছেড়ে বেরিয়ে গেলে, ওয়াশরুম পাবেন না আর।
  • বান্দিপোরা এ যদি লাঞ্চ না করেন তাহলে একেবারে ত্রাগবাল এ গিয়ে খাবার জায়গা পাবেন। ওখানে খুব বেসিক স্নাক্স এর দোকান আছে ২-৩ খানা। চা, কফি, বিস্কুট, চিপস, ম্যাগি এইসব জিনিস পাবেন। বসার জায়গা আছে এবং জায়গাটা খুবই সুন্দর লাগবে কিন্তু ওয়াশরুম আছে কিনা জানা নেই।
  • বান্দিপোরার পর বেশ অনেকটা ঘাট রোডস আছে - যাদের মোশন সিকনেস আছে তারা বান্দিপোরা পৌঁছানোর আগেই ট্যাবলেট খেয়ে নেবেন। আমি মোশন সিকনেস এর জন্যে ondem বলে একটা ওষুধ খাই, এর কোনো সাইড এফেক্ট আমি পাইনি তবে দরকারমতো ডাক্তার দেখিয়ে খাবেন।
  • ঠান্ডার জামাকাপড় হাতের কাছে রাখবেন, অনেক সময়ে যদি রাজদান পাস এ স্নোফল হয়ে তাহলে বেশ ঠান্ডা লাগে।
  • আধার কার্ড সবসমই হাতের কাছে রাখবেন এই রুটে। বেশ অনেক গুলো আর্মি চেক পোস্ট আছে যেখানে এন্ট্রি করতে হবে আধার নম্বর দিয়ে।
  • এই রুটটা কিন্তু বেশ সেনসিটিভ রুট কারণ এইটা বর্ডার এর কাছে তাই সবসমই নিজেদের ড্রাইভার এর কথানুসারে ব্যবহার করবেন। অর্থাৎ অযথা বেশি হই হট্টগোল করা, যত্রতত্র ফটো তোলা বা নেমে পড়া, আর্মির কথা না শোনা ইত্যাদি করবেন না। রুলস এন্ড রেগুলেশন গুলো আপনার আমার সুরক্ষার জন্যই আছে সেগুলোর সম্মান করবেন নাহলে বিপদে পড়তে পারেন। হতেই পারে চেক পোস্ট এ আর্মিরা আপনাকে অনেক ডিটেলস জিজ্ঞেস করছে ( সবসমই হবে এমন নয় - আমাদের প্রথম গুৱেজ ট্রিপ এ জিজ্ঞেস করেছিল শুধু দুজন মহিলা দেখে। পরের ট্রিপ এ করেনি ) সেগুলো শান্ত ভাবে উত্তর দেবেন।
  • আর্মি চেকপোস্ট যে সব জায়গায় দেখবেন সেখানে ফটো তোলা একেবারে এলাও না। সুরক্ষার কারণে এই রুল। যদি ভাবেন যে লুকিয়ে ফটো তুলে নেবো কেউ টের পাবে না - সেটা কিন্তু করবেন না - অনেক সময়ে আমি দেখেছি ওদের সার্ভিলেন্স ক্যামেরা এমন হয়ে যে বহু ফুট দূর থেকে ওরা লোকেট করে নেয় কে কোথায় ফটো তুলছে নিষিদ্ধ জায়গায়। তারপর এর জন্য আপনি বকা খাবেন এবং ক্যামেরা চেক করে ফটো ওরা ডিলিট করে দেবে। এই সব ঝামেলার মধ্যে তাই না যাওয়ায় ভাল। ( ব্যাপারটা হলো যে চেকপোস্ট যেখানেই আছে সেগুলো অন্যতম সুন্দর জায়গা তাই আপনার ইচ্ছে করবে ক্যামেরা বার করতে কিন্তু তবুও আবারো বলছি করবেন না !)
  • চেকপোস্ট এ আপনার ড্রাইভার সাধারণত সব এন্ট্রি করে দেবে আপনার আধার কার্ড নিয়ে গিয়ে, আপনাকে আলাদা করে নামতে হবে না গাড়ি থেকে। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রে যদি নামতে হয়ে তাহলে ড্রাইভারের নির্দেশ ফলো করবেন। অযথা গাড়ি থেকে নেমে ঘোরাঘুরি করবেন না যতক্ষণ এন্ট্রি হচ্ছে ততক্ষন টাইমপাস করার জন্য।
  • আচ্ছা যদি ড্রোন ওড়াতে চান গুৱেজ এবং আসে পাশের জায়গায় আগের থেকে ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্ট থেকে চেক করে নেবেন রুলস এর ব্যাপারে পরে নাহলে প্রব্লেম হতে পারে। একই ব্যাপার বড় সাইজের মোশন ক্যামেরার জন্য - আগের থেকে জেনে যাবেন এলাও কিনা। DSLR ক্যামেরার কোনো ইসু নেই।
  • আর্মিরা কিন্তু ট্যুরিস্টদের সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করে না, বরং আপনি যদি ভাল ব্যবহার করেন তাহলে অনেক সময়ে ওনারা আপনার সাথে একটু আধটু গল্প ও করতে পারেন। তবে জবরদস্তি করবেন না গল্প করার জন্য, অনেক সময়ে অন-ডিউটি ওনারা গল্প নাও করতে পারেন।
  • রাজদান পাস এ আপনি গাড়ি থেকে নামতে পারেন এবং চাইলে ফোটোগ্রাফি করতে পারেন। জায়গাটার নানা মরশুমে নানা রূপ তাই এখানে আলাদা করে ১০-১৫ মিনিট কাটিয়ে এগিয়ে যান।
  • ঘাট রোড এ ওঠার পর থেকেই ফোনের সিগন্যাল গায়েব হয়ে যায়, কোথাও কোথাও দুর্বল নেটওয়ার্ক পেতে পারেন।
  • রাজদান পাসের পরেই আপনার ডান হাতে পীর বাবার মাজহার পড়বে। আমি বলবো যাওয়ার দিন ওখানে না গিয়ে গুৱেজ থেকে যেদিন ফিরবেন সেদিন ওখানে থেমে ঘুরে আসবেন কারণ তখন ওটা রাস্তার বাম দিলেই পেয়ে যাবেন তাই আর রাস্তা ক্রস করতে হবে না।
  • যারা পাহাড়ে ঘুরেছেন তারা জানেন যে পাহাড়ি রাস্তায় ভেড়া, ছাগল ইত্যাদি পশুদের প্রথম প্রেফারেন্স থাকে এগিয়ে যাওয়ার। আপনাকে ধৈর্য ধরতে হবে যদি কোনো পশুপালক এবং তার পশুদের রাস্তা পার হতে দেখেন তো।
  • এই পুরো রাস্তায় এতো সুন্দর সুন্দর দৃশ্য আছে যে আপনার বার বার মনেই হতে পারে দাঁড়িয়ে ফটো তুলি, কিন্তু সেই করতে গিয়ে পরে দেরি হয়ে যেতে পারে তাই সময়ের খেয়াল রাখবেন।
  • সাথে কিন্তু জলের বোতল অবশই রাখবেন আর সাথে কিছু ছোটোখাটো স্ন্যাকস, পথে কাজে দেবে।
  • গুরেজে আপনি হয়ে মার্কেট এরিয়ার কাছে থাকতে পারেন নাহলে আমি সাজেস্ট করবো একটু দূরে থাকুন যেমন wampora গ্রামে। এখন থেকে মার্কেট গাড়িতে ৭-৮ মিনিট কিন্তু ভিউ বেশি ভাল পাবেন আর গ্রামের আশপাশ ঘুরে দেখতে পারবেন পায়ে হেঁটে সকাল সকাল।
  • যদি আপনারা পাইন ট্রি রিসোর্ট এ থাকেন গুৱেজ এ তাহলে অবশ্যই ফার্স্ট ফ্লোরের হাব্বা খাতুন ভিউ রুমটাই বুক করবেন - ঐটাই বেস্ট ভিউ এন্ড বেস্ট রুম।
  • গুৱেজ পৌঁছাতে পৌঁছাতে আপনার বিকেল হয়ে যাবে। কিন্তু গুরেজে সন্ধে বেশ দেরিতে নামে, তাই সামান্য বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন আসে পাশের এক দুটো জায়গা কভার করার জন্যে - যেমন কেন্দ্যাল টপ, ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড ইত্যাদি। বা যদি ইচ্ছে করে পায়ে হেঁটে আসে পাশে ঘুরে বেড়ান।
  • গুরেজে আপনি ডিনার আর ব্রেকফাস্ট তা ইনক্লুড করে নেবেন প্যাকেজ এ। কারণ যদি মার্কেটের কাছে না থাকেন তাহলে কিন্তু এখানে কোনো রেস্টুরেন্ট আলাদা করে পাবেন না, তাই যে হোটেল এ থাকছেন সেখানেই ডিনার বলে রাখুন।
  • যদি মার্কেটের কাছে থাকেন তাহলে লগ হাট ক্যাফে আছে, খাবারের মান বেশ ভাল, ওখানে গিয়ে খেতে পারেন।
  • মনে রাখবেন এসবই সীমান্তবর্তী গ্রাম ।, তাই এখানে শহরের মতো হই হট্টগোল, চাক চমক একেবারেই পাবেন না। নির্ভেজাল প্রকৃতি উপভোগ করার মন নিয়ে যাবেন তাহলে নিরাশ হবেন না।


আগের পর্বের লিংক :

No comments:

Post a Comment