Pages

Monday, 15 April 2024

Offbeat Kashmir Trip (May 2022) - পুনে থেকে শ্রীনগর | নিশাত বাগ | ডাল লেক

Nishat Bagh

এবারের কিস্তিতে ভ্রমণের বৃত্তান্তটা একটু বেশি ডিটেল এ লিখলাম যাতে ছোট খাটো ব্যাপারগুলো কভার হয়, ধৈর্য নিয়ে পড়ার জন্য আগাম ধন্যবাদ।
এই দ্বিতীয় কিস্তিতে থাকছে পুনে থেকে শ্রীনগর এর জার্নির গল্প আর প্রথম দিন আমরা কি কি করলাম তার বৃত্তান্ত।

বাড়ি থেকে এয়ারপোর্ট
ঘুটঘুটে অন্ধকার রুমের মধ্যে বেড হাতড়ে মোবাইলটা আবারো তুলে ধরলাম - মোবাইল জলে উঠে জানালো, ৩:৩০ বাজছে। বিগত আধঘন্টা ধরে প্রায় শোয়া আর জাগার মাঝামাঝি কথাও আটকে রয়েছি আমি - সময়ে যেন কচ্ছপের মতো এগোচ্ছে আর আমার এদিকে টেনশন বেড়ে চলেছে যে যদি ঘুমের ঘোরে ৪ টের অ্যালার্ম মিস করি তাহলে কাশ্মীর যাওয়া মাথায় উঠবে। প্রায় জোর করেই আবারো চোখ বন্ধ করলাম। কতক্ষন ঝিমুনির মধ্যে কেটে গেছে জানি না কিন্তু হুশ ফিরতেই ধড়মর করে উঠে বসলাম - আবার মোবাইলের খোঁজ। ৩:৫০ বললো মোবাইল। উঠেই পড়লাম শেষমেশ - ৪ টের অপেক্ষা আর করতে পারছি না !
চটজলদি তৈরী হয়ে ৫ টার মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম। তখন কাক ভোরও হয়নি - বাইরে অন্ধকার আর দূর আকাশে সামান্য রক্তিম আভাস দেখা যাচ্ছে। আমার এক পরিচিত অটো কাকুকে বলা ছিল সে ততক্ষনে হাজির। ব্যাগপত্তর চাপিয়ে আমরাও বসে পড়লাম অটোতে। মে মাস হলেও, পুনে তে ভোর বেলায় বেশ ঠান্ডা থাকে তাই শাল আর স্কার্ফ বের করে জড়িয়ে নিলাম আমরা। বাড়ি থেকে এয়ারপোর্ট প্রায় ৪৫ মিনিট, তাই ঘুমিয়ে থাকা পুনের দৃশ্য এনজয় করতে করতে পৌঁছে গেলাম এয়ারপোর্ট। এতো ভোরেও ভিড় কিন্তু কিছু কম ছিল না, তবে এয়ার ইন্ডিয়ার কাউন্টার এ শুধু দিল্লিগামী ( আমাদের ফ্লাইট ) এর ভিড়। ইন্ডিগোর মাইল দুয়েক লম্বা লাইন দেখে আবারো মনে মনে খুশি হলাম যে ভালো হয়েছে ইন্ডিগো বুক করিনি। ব্যাগপত্র স্ক্রীনিং আর ড্রপ এর পর এগিয়ে গেলাম সিকিউরিটির জন্যে।
বহুকাল পর আবার এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে যাবো (কাজের সূত্রে শেষ ২০১০ এ এয়ার ইন্ডিয়া তে গেছিলাম নিউ ইয়র্ক, দারুন অভিজ্ঞতা হয়েছিল - খাবার খাইয়ে খাইয়ে প্রায় গলা অব্দি ভোরে দিয়েছিলো । সাধারণত আমরা লো কস্ট কেরিয়ার যেমন ইন্ডিগো, ভিস্তারা, স্পাইস জেটের মতোই কেরিয়ার প্রেফার করি তাই এবারে এয়ার ইন্ডিয়াতে যাবো ভেবে বেশ আনন্দ হচ্ছিলো। তার উপরে সদ্য রিভাইভ আর রিভ্যাম্প হয়েছে এয়ারলাইনটা - তাই উত্তেজনা টা একটু বেশি ছিল - সার্ভিস উপগ্রডেড হবে এই আশায়। তো যাইহোক সিকিউরিটি চেকও ভালোভাবেই হয়ে গেল। তখনো কিন্তু ভ্যাকসিনেশন সার্টিফিকেট দেখাতে হতো সিকিউরিটি চেক এর আগে।
শাবির ভাই ( আমাদের টুর অপারেটর ) এর মধ্যে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে আমরা মোটামুটি ১০ থেকে ২৫ ডিগ্রীর মধ্যে টেম্পারেচার পাবো যেখানে যেখানে যাচ্ছি। Accuweather app কিন্তু তখনও আমাকে বলে চলেছে গুরেজে আমরা ০ ডিগ্রী পাবো। সাথে ভালো ঠান্ডার জামা কাপড় রয়েছে তাই অত চিন্তা হচ্ছিলো না। এখানে একটা ছোট্ট টিপস দি - ঠান্ডার জন্য বেস্ট উপায়ে হলো লেয়ারইং করা - মানে একটা বিশাল মোটা সোটা সোয়েটার / জ্যাকেট পরার চেয়ে দু তিনটে লেয়ার সাথে রাখুন - থার্মাল, টি শার্ট /কুর্তা , পাতলা সোয়েটার, জ্যাকেট , শাল। যত বেশি লেয়ার তত বেশি গরম থাকবেন ঠান্ডার মধ্যে । আর যখন গরম লাগবে দরকারমতো একটা আধটা খুলে ফেললেই হলো। তাতে আপনার ব্যাগ এর স্পেসেও বাঁচবে আর ওজনও ম্যানেজ হয়ে যাবে। যারা শপিং করতে খুব ভালোবাসেন, তারা যাওয়ার সময়ে ব্যাগ টা অল্প খালি রাখুন বা এক্সট্রা কোলাপ্সিবল ব্যাগ সাথে নিয়ে নিন কেনাকাটার পরে কাজে আসবে। এখানে আর একটা ইনফো দিয়ে দি - এয়ার ইন্ডিয়া বাছার আর একটা কারণ ছিল - এরা পার পারসন ২০ কেজি পর্যন্ত ব্যাগেজ এলাও করে বেসিক ক্লাস এ। তাই যদি ২ জন থাকেন তাহলে আপনি ৪০ কেজি পর্যন্ত কেবিন ব্যাগেজ নিয়ে যেতে পারবেন অনায়াসে যেটা ইন্ডিগোর থেকে অনেক বেশি। তাই আমি রেকমেন্ড করবো, টাকা একটু বেশি হলেও এয়ার ইন্ডিয়া আয় দেয় বেশি। তার উপরে আপনি ইন-ফ্লাইট খাবার পাবেন - সেই নিয়ে পরে আরো জানাচ্ছি।

শুরুতেই হলো দেরি
কাউন্টার এর মহিলা আমাদের যে গেট নম্বর বলে দিয়েছিলো আমরা সেইমতোই দ্বিতিয় ফ্লোর এ গেট গিয়ে পৌঁছালাম। দেখি ওখানে তিল ধরণের জায়গা নেই - বেশ খানিকটা আশ্চর্য হলাম, ফ্লাইট ছাড়তে এখনো সময়ে আছে, তাহলে এতো ভিড় কোনো বোর্ডিং গেটে এ ? একবার তাই ডিসপ্লে বোর্ড টা চেক করতে গেলাম, দেখি গেট নম্বর বদলে গেছে আমাদের, পাশের গেটে যেতে হবে। ব্যাপারটা ভালোই হলো - পাশের গেটে তখন অনেক চেয়ার ফাঁকা - তাই আমরা গিয়ে একটা ভালো জায়গা খুঁজে বসে পড়লাম। তখন ঘড়ি বলছে ৩০ মিনিট বাকি ফ্লাইট ছাড়তে - ৭:২০ নির্ধারিত সময়। আমরা একটু চা কফি খেয়ে নিলাম তার মধ্যে। টুকটাক গল্প আর ফোন ঘেঁটে ৩০ মিনিট কখন শেষ হয়ে গেল, কিন্তু দেখি আমাদের গেটে তখনো এয়ার লাইনের কোনো স্টাফ আসেনি। আবার ডিসপ্লে বোর্ড চেক করতে গেলাম যদি আবার গেট বদলে থাকে। গেট দেখলাম ঠিকই আছে কিন্তু বাকি কারো পাত্তা নেই। এবারে লোকেরাও ধীরে ধীরে অস্থির হচ্ছে - কেউ কিছু বুঝে পাচ্ছে না ব্যাপার কি। ঠিক তখনি আমাদের ফোনে SMS এলো দিল্লির থেকে যে ফ্লাইট আমাদের নিয়ে যাবে সেটা এখনো পৌঁছায়নি, ফগ এর কারণে দেরি হচ্ছে , আরো ৩০ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। হাতে তখন ভালোই টাইম আছে দিল্লি থেকে কানেকটিং ফ্লাইট ধরার জন্যে তাই আমি তখন বিশেষ চাপ নেইনি। কিন্তু এর কিছুক্ষনের মধ্যেই আবারো আর একটা SMS - আরো ডিলে হচ্ছে ফ্লাইট এর। এবার শুরু হয়ে সবার টেনশন - পরের ফ্লাইট এর জন্যে মাঝখানে মাত্র ১ ঘটার ব্যবধান কিভাবে কি হবে তাই নিয়ে চিন্তা হতে থাকে। আমি এরকমই অবস্থার কথা ভেবেই একই কেরিয়ার থেকে দুটো ফ্লাইটি বুক করেছিলাম আর তার লাভটাও হাতে নাতে পেয়ে গেলাম। এয়ার ইন্ডিয়ার গ্রাউন্ড স্টাফ রা শেষমেশ গেটে এসে জানায় যে, তারা দিল্লি তে খবর দিয়ে দিয়েছে আমাদের ডিলের তাই আমাদের কানেকটিং ফ্লাইট আমাদের ছেড়ে যাবে না - ৩৫ জন যাত্রী আছে যারা একই কানেকটিং ফ্লাইট নেবেন। আমরা আশ্বস্ত হই কিন্তু যাদের পরের ফ্লাইট টা অন্য কেরিয়ারের ছিল তাদের অবস্থা শোচনীয়। তাদের দৌড়া দৌড়ি শুরু হয়ে কিভাবে ম্যানেজ করবে সেই খোঁজ খবর নিতে। আর একটা ব্যাপার, একই কেরিয়ার হলে চেক ইন লাগেজ অটো ট্রান্সফার হয়ে যে পরের ফ্লাইট এ। কিন্তু বাকিদের হলেও হতে পারে যে লাগেজ কালেক্ট করে আবারো চেক ইন করতে হবে, তাই তাদের জন্যে আরো বেশি প্রব্লেম। শেষমেশ এরা কি করেছিল জানি না কিন্তু এদের ট্রিপ টা প্রথম থেকেই ঘেঁটে গেছিলো এইটুকু বলতে পারি। আমাদের বোর্ডিং হয়ে ৮:২০ নাগাদ আর আরো ২০ মিনিট লাগে টেক অফ করতে। এরমধ্যে শাবির ভাই আমাদের ড্রাইভার এর নাম নম্বর পাঠিয়ে দিয়েছিলো - এয়ারপোর্ট এ বসেই খুরশীদ ভাই কে কল করে জানিয়ে দি ফ্লাইট দেরিতে পৌঁছাবে ( আমাদের ড্রাইভার)।

ফ্লাইট এর হাল হাকিকত
যেহেতু তখনো কোভিড রুলস মানা হতো তাই ফ্লাইট উঠে আমাদের বলা হয়ে সবসময়ে মাস্ক পরে থাকতে হবে। এছাড়া আর কোনো সমস্যা হয়নি ফ্লাইট এ। নতুন এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট টা বেশ পরিষ্কার পরিছন্ন ছিল। তার সাথে সিটগুলো অনেক বেশি কমফোর্টেবল ছিল। টেক অফ এর কিছুক্ষনের মধ্যেই আমাদের জন্য এলাহী ব্রেকফাস্ট হাজির - নন ভেজদের জন্যে ওমলেট, পটেটো ওয়েজ, ব্রেকফাস্ট বান, মাফিন আর মিষ্টি দই। ভেজদের জন্যে উপমা, পটেটো ওয়েজ, ব্রেকফাস্ট বান, মাফিন আর মিষ্টি দই। এর সাথে বাটার, জ্যাম , চা , কফি তো ছিলই। ফ্লাইট এ উঠলে আমার মুখে রুচি থাকে না বেশি কিছু খাওয়ার - কিন্তু এদের দেওয়া মিষ্টি দইটা যেন খিদে আরো বাড়িয়ে দিয়েছিলো। ফ্লাইট এ বসে টক দই থেকে মিষ্টি দই খেতে যে কত ভালো লাগে টা সেদিন বুঝতে পারি। আমরা পুরো খাবার শেষ করতে পারিনি তাই সাইড ব্যাগ এ মাফিন, বান ইত্যাদি ঢুকিয়ে নিয়েছিলাম, পরে দরকার হলে খাবো ভেবে।
Veg Meal

Non veg Meal


দিল্লি পৌঁছে দৌড় দৌড় দৌড় !
যতক্ষনে আমরা দিল্লি পৌঁছাই ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গেছে - পরের ফ্লাইট ছাড়ার সময় অলরেডি পেরিয়ে গেছে। ফ্লাইট আমাদের T3 টার্মিনাল এ নামিয়ে দেয়। দরজার সামনেই এয়ার ইন্ডিয়ার গ্রাউন্ড স্টাফ রা দাঁড়িয়ে ছিল - আমাদের বলা হলো সোজা চলে যান, শেষে গিয়ে লেফ্ট নেবেন। এই 'সোজা' ব্যাপারটা যে অতটাও সোজা নয় বুঝতে পারি ক্ষনিকের মধ্যেই। ওয়াকিং এস্কেলেটর থাকা সত্ত্বেও আমাদের এস্কেলেটরের উপর দিয়েই দৌড়াতে হচ্ছিলো। দৌড়াচ্ছি তো দৌড়াচ্ছি , সেই 'লেফ্ট' এর আর দেখা মেলে না। এদিকে মা হাফিয়ে পড়ছে, আমার হাফ ধরে যাচ্ছে - দুজনের পিঠেই ছোট ব্যাকপ্যাক। বোধহয় ৪-৫ মিনিট এরম দমবন্ধ করে দৌড়ানোর পর সিকিউরিটি গেট দেখতে পাই লেফ্ট এ। পড়ি কি মরি করে কোনো মতে সিকিউরিটি ক্রস করি আমরা।
সিকিউরিটি চেক এর পর গেট নম্বর দেখে আবারো দৌড়। আর একেই বলে ভাগ্য - আমাদের ফ্লাইট দিয়েছে একেবারে শেষের গেটে (৩৫ না কত এখন মনে নেই - ইলেকট্রিক কার্ট পাওয়া যায় কিন্তু আমাদের সময় ছিল না কতক্ষনে খালি ই-কার্ট আসবে তার অপেক্ষা করার জন্য ) - দৌড়াতে দৌড়াতে নিজেকে উসেন বোল্ট বলে মনে হচ্ছিলো তখন ! শেষমেশ এতো কান্ড করে যখন হাঁপাতে কাঁপাতে প্লেনে উঠি তখন পুনের থেকে আশা যাত্রীগণ ছাড়া বাকি সবাই বসে পড়েছে - আমাদের দিকে সবাই এমন তির্যক নজরে তাকাচ্ছিলো যেন আমরাই ফ্লাইট দেরি করে চালিয়ে এনেছি। যাইহোক ঐসব অদেখা করে পৌঁছে গেলাম সিটে। তখনো আরো মজা বাকি ছিল - গিয়ে দেখি আমাদের সিটে দুই বয়স্ক মহিলা বসে আছেন। পোশাক আষাক গয়নাগাটি দেখে মনে হয়ে বেশ বড়োলোক ঘরের। ওরা বোধহয় ভেবেছিলেন আমরা আর আসছি না। যখন ওনাদের সরতে বলি তখন এমন আশ্চর্য ভাবে তাকান আমার দিকে যেন আমি লিভার চেয়ে বসেছি ! যাইহোক শেষমেশ সিট পেলাম - এবং পরবর্তী কালে দুইয়ের মধ্যে এক মহিলা আমার মায়ের সাথে ভাব পাতিয়ে নেন - জানা যায় ওনারা কাশ্মীরি, কিন্তু দুবাইতে থাকেন , এখন চলেছেন ছেলের বাড়ি শ্রীনগরে। সেই প্রথম আভাস পাই যে কাশ্মীরিরা গল্প করতে ভালোবাসেন।
আচ্ছা এই ফ্লাইট ও কিন্তু আমাদের কিছু একটা স্নাক্স দিয়েছিলো, পেট ভরা থাকায় সেটাও আমরা ব্যাগে ভোরে নিয়ে আসি।



অবশেষে শ্রীনগর
গল্প করতে করতেই কখন আমরা শ্রীনগরের আকাশে পৌঁছে গেলাম বুঝেতেই পারিনি। নিচে ঘন সবুজ উপত্যকার হাতছানি - মধ্যেখানে দিয়ে বয়ে চলেছে একটা বড় নদী। এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে লাল আর সবুজ টিনের ছাদের বাড়ি, গাড়ো আর হালকা সবুজে মাখা খেত খামার। কিন্তু কথাও বিল্ডিং এ চোখ আটকাচ্ছে না , শুধু সবুজ আর সবুজ। সকালের ক্লান্তি ভুলে গেলাম এই দৃশ্য দেখে। সেই গল্পে পড়া, সিনেমায় দেখা কাশ্মীরে আমরা পা রাখতে চলেছি !
আমরা এরো ব্রিজের পেটের মধ্যে দিয়ে চলে এলাম এয়ারপোর্টের মধ্যে। উত্তেজনা তখন তুঙ্গে, ভাবতেই পারছিনা যেন কাশ্মীরে পৌঁছে গেছি। এস্কেলেটর দিয়ে নিচে নেমে এসে ব্যাগেজ কারাওসাল। এস্কেলেটর দিয়ে নামতে নামতেই যে জিনিসটা প্রথম নজরে কাড়ে সেটা হলো একটা প্রমান আয়তনের শিকারা ( ৬০ ফুট)। এক নম্বর ব্যাগেজ বেল্ট এর উপরে সাজিয়ে রাখা এই সুন্দর শিকারাটি আপনাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে দেয় মুহূর্তের মধ্যেই। হয়তো ক্ষনিকের জন্য ভুলেও যেতে পারেন যে আপনি ব্যাগের জন্য ওয়েট করছেন - বরং আপনার পুরো ধ্যান থাকে সেলফি আর ফটো তুলতে ! হুঁশ ফিরবে যখন কনভেয়র বেল্ট এ ব্যাগ আসা শুরু হবে। এয়ারপোর্টটা ছোট হলেও, পুনের তুলনায় অনেক কম সময়ে আমরা ব্যাগ গুলো পেয়ে গেলাম। বেল্ট এ দাঁড়িয়েই আমি খুরশীদ ভাই কে ফোন করে জানিয়ে দি আমরা পৌঁছে গেছি আর কিছুক্ষনের মধ্যেই বাইরে আসছি।
এর মধ্যে আবার এক কমবয়সী মহিলা আমাকে ফোন দেখে বলে যে দেখুন তো কেন আমার নেটওয়ার্ক আসছে না ফোনে। আমি তার ফোন টা নিয়ে সেটিংস এ গিয়ে চেক করে, এরোপ্লেন মোড অন অফ করেও দেখি নেটওয়ার্কের নো পাত্তা। আমি প্রশ্ন করি যে আপনার পোস্টপেইড নম্বর তো? তখন তিনি বলেন না তো ! আমি তাকে জানাই দিদি কাশ্মীরে শুধু পোস্টপেইড চলবে বা আপনি শহর থেকে লোকাল সিম নিয়ে নেবেন। আপনারাও কিন্তু এটা মাথায় রাখবেন - কাশ্মীরে শুধু পোস্ট পেইড সিম চলে - ভি, এয়ারটেল, জিও সব চলবে। পোস্টপেইড সিম না থাকলে আধার কার্ড দিয়ে এয়ারপোর্ট এর বাইরে থেকে লোকাল প্রি পেইড সিম নিয়ে নেবেন।
আর একটা জিনিস যেটা প্রথমেই চোখে পড়বে আপনার, কাশ্মীরি মহিলা এবং পুরুষ - টুকটুকে গোলাপি গায়ের রং এবং ততোধিক সুন্দর দেখতে মানুষজন। শুধু যে রূপে নয়, এরা যে মনের থেকেও ততটাই সুন্দর সেটা ধীরে ধীরে বুঝতে পারি। এয়ারপোর্ট থেকে শ্রীনগরের দূরত্ব প্রায় ঘন্টা খানেক তাই, এয়ারপোর্ট থেকে বেরোনোর আগেই একবার ওয়াশরুম হয়ে আসবেন । লাগেজ বেল্টের পাশেই আছে ওয়াশরুম।
তখনও বুঝতে পারিনি বাইরে কেমন ঠান্ডা। আমরা এক্সিট সাইন অনুসরণ করে এগোতে থাকলাম। এয়ারপোর্ট এর বাইরে পা রাখতেই দুটো জিনিস হলো - এক তো একটা সূক্ষ্ম ঠান্ডার চাদর যেন আমাদের জড়িয়ে ধরলো। আর দ্বিতীয়ত সামনে দেখলাম একটা বিশাল জাতীয় পতাকা - এতো বড় ফ্লাগপোস্ট খুব কম দেখেছি। এবারে খোঁজ শুরু হয়ে খুরশীদ ভাইয়ের। আমি কল লাগাই কিন্তু লাগে না, দু তিন বার চেষ্টা করার পর ওনারই কল চলে আসে। কিছুক্ষনের মধ্যেই হাজির তিনি। দেশের অন্য জায়গায় যেমন আমরা ছেলেদের 'দাদা' বা 'ভাইয়া' বলে থাকি, কাশ্মীরে তেমন সবাইকে নামের সাথে 'ভাই' বলে সম্ভোধন করতে হয়ে। খুরশীদ ভাই আমাদের হাত থেকে সব বড় লাগেজ নিয়ে নেন, কিছুতেই শোনেন না সব নিজেই নিয়ে যান গাড়ি পর্যন্ত। গাড়ির মডেল স্করপিও। গাড়িতে উঠে বুঝতে পারি গাড়ির কন্ডিশন খুবই ভালো আর ভালো ভাবে মেনটেন্ড। শাবির ভাই কথা রেখেছেন।



জন্নাতের (স্বর্গের ) হাতছানি
জয় মা বলে এয়ারপোর্ট ছাড়িয়ে বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। রাস্তার মাঝ বরাবর রয়েছে সুন্দর গাছ আর ফুলের সারি। এই রাস্তাটুকুও এয়ারপোর্টেরই অংশ তাই খুব সুন্দর সাজানো গোছানো। বাইরে মনোরম আবহাওয়া - এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে যেরকম ঠান্ডা লাগছিলো তখন আর সেরম লাগছিলো না - বরং বেশ ভালো লাগছিলো হালকা মিঠে রোদের সাথে হাওয়াটা। সাথে নির্মল স্বচ্ছ নীল আকাশ - এতো সুন্দর খোলা আকাশ শহরে খুব কম দেখা যায়। মাঝেমধ্যেই আবার দেখা যাচ্ছে সুন্দর সুন্দর গল্পকথার মতো বাড়ি ঘর - তাদের লাল ঢালু ছাদ গুলো দেখে কে বলবে আমরা ভারতেই রয়েছি।
প্রায় হারিয়েই গেছিলাম শ্রীনগরের রূপে, ঘোর কাটলো প্রথম মিলিটারি ট্রাক টা দেখে - জলপাই সবুজ, চারদিক ঘেরা বেশ উঁচু একটা ট্রাক। তার মাথা দিয়ে একটা ঘুলঘুলির মধ্যে দিয়ে একজন আর্মড মিলিটারির লোককে দেখা যাচ্ছে - হাতে AK-47 বা ওই ধরণের কোনো বন্দুক। আমাদের সামনেই যাচ্ছিলো ট্রাকটা। ক্ষনিকের জন্যে দৃশ্যটা দেখে সন্ত্রস্ত লাগলো - আমরা তো আর রোজ রোজ রাস্তায় বন্দুক হাতে কাউকে ঘুরতে দেখতে অভস্ত নই। কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যেই ব্যাপারটা বেশ নরমাল হয়ে গেল। পুলিশ বা মিলিটারি একটু বেশি করে দেখা যায় এই এয়ারপোর্ট এর রাস্তায় কিন্তু তারা সিভিলিয়ান দের কিছু বলেন না, মজুত থাকেন কোনোসময় যদি দরকার পড়ে তার জন্যে। আর সেই সময় আর্টিকেল ৩৭০ র রেশ একটু আধটু ছিল তাই এই সব সতর্কতা। এর পর কিন্তু আর কোনদিনও কিছু মনে হয়নি মিলিটারিদের আসে পাশে দেখে।
আমরা এয়ারপোর্ট পৌঁছাই প্রায় ১:৩০ নাগাদ , তারপর বেরোতে বেরোতে প্রায় ২ টো হয়ে গেছিলো। ততক্ষনে সকালের খাবার হজম হয়ে আবার খিদে পেয়ে গেছে। খুরশিদ ভাই বলেন যদি খিদে পেয়ে থাকে তাহলে উনি ভালো রেস্টুরেন্ট চেনেন, সেখানে দাঁড়াতে পারেন। কিন্তু ঘোরার জায়গার মতো আমি খাবারেরও লিস্ট বানিয়ে এনেছিলাম (বাঙালিদের জন্যে খাওয়াটা ততোধিক ইম্পরট্যান্ট কিনা) - আমি শ্রীনগরের তুজ (গ্রীলড কাবাব) এর কথা অনেক শুনেছিলাম আর তার সাথেই শুনেছিলাম খায়াম চৌক বলে একটা জায়গার যেখানে কিনা বেস্ট তুজ পাওয়া যায়। আমি বললাম গুগল ম্যাপ হিসাবে চলতে থাকুন আমরা লাঞ্চ খায়াম চৌকেই করবো। খুরশীদ ভাই আমাকে এক দুবার বললেন বটে যে খায়াম চৌক কেন যাবেন আরো ভালো রেস্টুরেন্ট আছে , কিন্তু আমি তখন ভাবছি ইনি হয়তো যেতে চাইছেন না বলে এড়াচ্ছেন তাই আমি নিজের কোথায় ফিক্সড রইলাম।
খুরশীদ ভাইয়ের সাথে আমরা একটু আধটু গল্প করার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু উনি ছোট খাটো উত্তর দিয়েই থেমে যাচ্ছিলেন। বুঝতে পারছিলাম না কিভাবে ভাব পাতানো যায় - আর ভাব হওয়াটা খুব জরুরি ছিল কারণ আমরা এমন সব রিমোট জায়গায় যাবো যে ওখানে ড্রাইভার মশায়ের সাথে যদি ভাব না হয়ে তাহলে মুশকিল হতে পারে।
এর মধ্যে আমরা শ্রীনগরের সীমানায় পৌঁছে গেলাম। সুন্দরী ডাল লেক এর প্রথম ঝলক কিন্তু খুব বেশি সুন্দর লাগলো না। তার কারণ সর্বপ্রথম যেটা দেখা যায় তা হলো লেকের ব্যাকওয়াটারের একটা ছোট্ট অংশ। সেখানে অবহেলিত আর ভেঙে যাওয়া হাউস বোট আর শিকারা পড়ে রয়েছে অনেক। কিছু পুরোনো হাউস বোটের অংশ ভেঙে জলের মধ্যে তলিয়ে গেছে।
এই দৃশ্যের জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না। জানতে চাইলাম খুরশিদ ভাইয়ের কাছে এগুলো কাদের। উনি বললেন এগুলোতে মালিক নিজেও থাকতো আবার টুরিস্টদের জন্য ব্যবহার হতো, এদের আয়ু শেষ তাই এখানে পড়ে রয়েছে। জানতে চাইলাম কিরকম দাম হয়ে বোটগুলোর। জানতে পারলাম যে সিঙ্গেল বেডরুম বোটের দাম ৭৫ লক্ষ থেকে শুরু আর ১ -২ কোটি ৪ বেডরুম বোটের জন্য। শুনে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ ! এত্ত দামি জিনিস এভাবে পড়ে রয়েছে ! জানলাম যে কিছু করার নেই, একটা বোট যখন খারাপ হয়ে যায় আবার লোন নিয়ে বোট কেনে লোকে ( বারে বারে কাশ্মীর গিয়ে উপলব্ধি করি যে এরা সবাই কিন্তু খুব যে গরিব তেমন নয় - এদের পৈতৃক জমি জায়গা ব্যবসা আছে কিছু না কিছু তাই যদি কেউ শুধু ড্রাইভেরিও করে তারাও কিন্তু গরিব ঘরের নয় )।



কাশ্মীরি তুজ - প্রথম অভিজ্ঞতা
আমার আব্দারের খায়াম চৌক যেতে গিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পেলাম কেন খুরশিদ ভাই আসতে চাইছিলনা এখানে। গুগল ম্যাপ যে খাও গালিটা দেখায় সেটা মোটেই ডাল লেকের পাশের সুন্দর খাও গালি নয় - ছোট্ট ঘিঞ্জি আলী গলি হয়ে যেতে হয়ে - ভালো রকম ট্রাফিক পাওয়া যায় দুপুরে। আর ম্যাপ যেখানে আমাদের পৌঁছে দিলো সেখানে ২ -৩ খানা খাবার দোকান ছাড়া কিছু নেই। বুঝলাম কাশ্মীরে লোকাল লোকেদের সাজেশন শোনাই বেটার। খুরশিদ ভাই আমাদের নামিয়ে দিলেন আর সামনেই পার্ক করলেন গাড়ি। একটা দোকান যেটা মোটামোটি বড় আর পরিষ্কার মনে হচ্ছিলো তাতেই ঢুকলাম। ভেতরে কিছু লোকেরা খাচ্ছিলো, কোনো মহিলার দেখা নেই। প্রথমে ভাবলাম বেরিয়ে আসি, তারপর দেখলাম অনেক দেরি হয়ে গেছে এমনিতেই, খিদেও পেয়েছে জোরদার - তাই বসে পড়লাম আমরা খেতে। কিছুক্ষনের মধ্যে অবশ্য একটি ফ্যামিলিও এসে বসলো তাই দেখে একটু শান্তি হলো। মেনু দেখে অর্ডার করলাম মটন তুজ আর সাথে লাভাশ রুটি। নানান তুজ ম্যারিনেট করে বাইরেই টাঙানো আছে - অর্ডার এলে সেটা কয়লার আগুনে গ্রিল করে পরিবেশন করছে, লাভাশ টা অবশ্য বাইরের কোনো দোকান থেকে নিয়ে আসছে দেখলাম যেমন যেমন অর্ডার আসছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই খাবার এসে গেল - পার প্লেট দুটো করে তুজএর সিখ যার মধ্যে ৫ পিস্ করে মটন গাঁথা, দু পিস লাভাশ, আর ৩-৪ রকমের চাটনি। মটন তুজ টা খিদের মুখে খারাপ লাগেনি কিন্তু চাটনি গুলো জাস্ট দুর্দান্ত লেগেছিলো। মুলো, আখরোট , টমেটো , দই - চার ধরণের চাটনি খুবই অভিনব আর টেস্টি ছিল। এরপর অবশ্য যতদিন থেকেছি, যতবার গেছি সবসময়েই এই চাটনি গুলো নানা ভাবে পেয়েছি। লাভাশটা একটু শুকনো ধরণের রুটি যেটা আমার খুব একটা ভালো লাগেনি। মোট কথা পেট ভরলেও মন ভরলো না খেয়ে। যাইহোক আমরা পে করে বেরিয়ে এলাম। এবার গন্তব্য হোটেল।
Imran Cafe

Mutton Tujj
ডাল লেক আর বুলেভার্ড রোড
আকাশটা সেদিন সামান্য মেঘলা ছিল - যেন রোদ আর ছায়ার খেলা চলছে। আমরা বুলেভার্ড রোড এ ঢুকে পড়লাম কিছুক্ষনের মধ্যেই আর তার সাথে সাথেই বদলে গেল চারিদিকের দৃশ্যপট। ডাল লেকের পাশ দিয়ে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রঙিন সব শিকারার সারি। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ কত কি রঙের বাহার। রাস্তার এপাড়ে রয়েছে সারি সারি হোটেল, দোকানপাট। কিন্তু সেদিকে নজরে যাচ্ছে না। সুন্দরী ডাল লেক মন কেড়ে নিচ্ছে তার শান্ত স্নিগ্ধ রূপ দিয়ে। মাঝে ডাল লেকের পাড়ে একটার পর একটা ঘাট, প্রত্যেক ঘাটের একটা নম্বর আছে। শনিবার হওয়া সত্ত্বেও রাস্তায় তখন ভিড় কম। এক দুটো বড় ট্রাভেলার বাস এসে টুরিস্ট নামাচ্ছে ঘাটে। ঘাট থেকে হাউস বোট পর্যন্ত নির্দিষ্ট শিকারা নিয়ে যাবে। আমরা হাউস বোটে স্টে নেইনি। তার কারণ হলো হোটেল পৌঁছাতে আজ প্রায় দুপুর গড়িয়ে যাবে আর কাল আমরা খুব ভোর ভোর বেরোবো গুরেজের জন্য। শুধু রাত টা কাটানোর ব্যাপার। আর আমার বন্ধ বোট এ থাকতে ঠিক ভালো লাগে না , বোট এ উঠে গেলে পাড়ে আসার জন্য শিকারার অপেক্ষা করতে হয়ে - এই সব ভেবে আমরা হাউস বোট নেইনি। আমরা ট্যুরিস্টদের ভিড় পেছনে ফেলে আরো এগিয়ে চললাম বুলেভার্ড রোড ধরে। মুম্বাইয়ের কুইন'স নেকলেস যারা দেখেছেন এই বুলেভার্ড রোড টি ঠিক তেমন ভাবেই ঘিরে রয়েছে সুন্দরী ডাল লেক কে। যত এগোচ্ছি তত সুন্দর লাগছে ডাল লেককে, নির্জন রাস্তা, সূর্যের উঁকি ঝুঁকি, সামনে জবারবান পাহাড় প্রহরীর মতো আগলে রেখেছে শহরটিকে, সবুজ চিনার আর উইলও গাছের সারি চারিদিকে - দৃশ্যটা যে কতটা সুন্দর তা শুধুমাত্র চোখে দেখেই উপলব্ধি করা যায়। এই চিনার গাছগুলোই শরৎ কালে আগুন রঙে রঙিন ওঠে - মনে মনে বললাম আবার আসিব ফিরে, ডাল লেকের তীরে, শরতের সময়।





হোটেল এসে মোহভঙ্গ
বুলেভার্ড রোড থেকে অনেকটা ভেতরে আমাদের হোটেল, নাম - নিশাত ভিউ। রাস্তায় নিশাত বাগ পড়বে। সেটা ছাড়িয়ে আমরা একটা সুন্দর গলির মধ্যে ঢুকে যাই যেখানে শুধু লোকালদের বাড়ি দেখা যায়। বেশ খানিক্ষন যাওয়ার পর রাস্তার শেষে দুটো হোটেল, ঠিক মতো নজরে না করলে মিস হয়ে যাওয়ার চান্স আছে। খুরশীদ ভাইও প্রায় মিস করছিলো কিন্তু আমি গুগল ম্যাপ দেখে বলে দি আমরা পৌঁছে গেছি। বাইরে থেকে দেখতে ভালো হলেও এই হোটেল টা মোটেই আমার মনোপূত হলো না রুম গুলো দেখে। ২ বা ১ ষ্টার হোটেলের মতো অবস্থা। প্রথম রুম টায়ে ঢুকে প্রায় দম বন্ধ হওয়ার জোগাড় - এতো সিগেরেটের গন্ধ, তার মধ্যে রুম এর শেপটা অদ্ভুত, জানলা ঘুলঘুলির মতো। আমি ঢুকেই জানিয়ে দি রুম চেঞ্জ চাই - তারপর ওরা অন্য একটা রুম দেয় যেটা আগেরটার থেকে সামান্যই ভালো, তবে বাথরুম টা পরিষ্কার। এক রাত কাটাতে হবে ভেবে ওকে বলে ঢুকে যাই। তবে এই হোটেল এ প্রচুর প্রব্লেম আছে রুম এ তাই বলবো যে একদমই বুক করবেন না এই হোটেল ( প্রথম কাশ্মীর ট্রিপ তাই পছন্দের হোটেল বাছতে পারিনি, পরের বার যতবার গেছি খুব ভালো ভালো হোটেল এ ছিলাম) ।

মুঘল গার্ডেন এর প্রথম দর্শন
আমরা একটু ফ্রেশ হয়েই বেরিয়ে পড়লাম সেদিনের সাইটসিইং এর জন্যে। প্রায় বিকেল হয়ে এসেছিলো তাই বেশি ঘোরাঘুরির চান্স নেই। তখনও বাইরে সূর্য তেজিয়ান তাই আমি ঠান্ডার কাপড় একেবারেই নিয়ে বেরোলাম না, পরে বুঝেছিলাম ভুলটা। যাইহোক আমাদের প্রথম স্টপ নিশাত বাগ। নিশাত বাগের সামনে ততক্ষনে জনসমুদ্র বেড়ে গেছে - প্রায় বাংলার মেলার মতো অবস্থা - খাবার দোকান, গাড়ি ঘোড়া , সুভেনিরের দোকান, লোকের ভিড় একেবারে জমজমাট অবস্থা বাইরে।
এটি ডাল লেকের পূর্ব তীরে অবস্থিত কাশ্মীর উপত্যকার দ্বিতীয় বৃহত্তম মুঘল বাগান। আমরা ২৪ টাকার টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম গার্ডেন এ। DSLR ক্যামেরার জন্যে আলাদা কোনো চার্জ নেই। এই বাগানটি পীর পাঞ্জাল রেঞ্জের জাবারওয়ান পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত। বাগানে ঢুকতেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম বাগানের স্থাপত্যশৈলী, লোকেশন, ফুলের সম্ভার, সামনে ডাল লেক আর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল পর্বতমালার সাথে মেঘের লুকোচুরি দেখে।
উর্দু শব্দ নিশাতবাগের অর্থ "আনন্দের বাগান"। ইসলাম কাশ্মীরে আসে ১৪ সেঞ্চুরি তে। তাদের হাত ধরেই আসে পারস্যের প্রভাব। এভাবে ভাষা, পোষাক, রীতিনীতির পাশাপাশি পারস্যের সাথে যুক্ত অনেক ধরনের শিল্প ও কারুশিল্পও এই অঞ্চলে বিকাশ লাভ করে। তাদের মধ্যে একটি বাগান বানানোর শিল্পও ছিল।ঐতিহাসিক রেফারেন্স থেকে মনে হয় যে এই উদ্যানগুলি পারস্যর প্যারাডাইস গার্ডেনগুলির প্যাটার্ন অনুরূপ বানানো হয়েছিল - সোপান দিয়ে ঘেরা একটি কেন্দ্রীয় জলের চ্যানেল যার মাঝ দিয়ে সারিবদ্ধ ফোয়ারা আর দুপাশে দিয়ে নানান বাহারি ফুল আর গাছের সারি।
সব মুঘল গার্ডেনের মতো নিশাত বাগও বিশাল এলাকা নিয়ে তৈরী। যদি বাগানটাকে ভালো ভাবে ঘুরে দেখতে চান তাহলে মিনিমাম ঘন্টা দুয়েক সাথে নিয়ে আসতে হবে। আর একটা ব্যাপার, বাগানটি ধাপে ধাপে উঠে গেছে - একসাথে অনেক সিঁড়ি না হলেও, অনেক হাঁটতে হবে,তাই বয়স্ক লোকেদের কষ্ট হতে পারে। আচ্ছা সাথে একটা জলের বোতল রাখতে পারেন, ক্লান্ত হয়ে গেলে তেষ্টা পাবে । আমরা মাঝ বরাবর গিয়ে আর উঠিনি, যেহেতু সময় কম ছিল হাতে। বাগানের মধ্যে জায়গায় জায়গায় ট্রাডিশনাল ফেরান ভাড়া পাওয়া যায়। আপনি নিজের ইচ্ছে মতো পোশাক পরে বাগানের মধ্যে ফটো তোলাতে পারেন। বাগান টা এতো সুন্দর যে আপনার ইচ্ছেই করবে না বেরোতে। তার মধ্যে আমরা ডাল লেকের উপরে অস্তগামী সূর্যের প্রতিফলন দেখে এরই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলাম। এদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে তাই খুরশীদ ভাইয়ের কল এসে গেল। কি আর করা যাবে বলে বেরিয়ে এলাম, শেষের দিন সময়ে থাকলে ফের দেখা হবে বলে।












পড়ন্ত বিকেলে ডাল লেক
নিশাত বাগ থেকে বেরোতে বেরোতে প্রায় ৬ টা বেজে গেছিলো। কাশ্মীরে অন্ধকার দেরিতে হয়ে সেটা প্রথম বুঝলাম সেদিনই। তখন আকাশে সূর্য বেশ খানিকটা উপরে। সবাই বলে সানসেট দেখতে দেখতে শিকারা রাইড নাকি বেস্ট - তাই আমার প্ল্যান ছিল সেটাই করার। কিন্তু বিধি বাম - দুপুরের ফাঁকা বুলেভার্ড রোডে তখন বাম্পার টু বাম্পার ট্রাফিক - সামনের গাড়ি গুলো নড়ছেই না। ১৫ মিনিট এভাবে ফেঁসে থেকে বুঝে গেলাম সানসেট গাড়ির ভেতরে বসেই দেখতে হবে, কোনোভাবেই কোনো ঘাট এ আমরা পৌঁছাতে পারবো না। কিন্তু ফিরে যাওয়ার উপায়ে নেই তাই গাড়ি এগোতে থাকলো। এখানে বলি যে আপনারা যদি সত্যি সানসেট রাইড করতে চান তাহলে ৬ তার অনেক আগেই ঘাটে চলে আসবেন। কারণ তারপর শিকারার জন্য দরদাম করতেও অনেক সময় যাবে।
গাড়িতে বসেই আমার জীবনের অন্যতম সেরা সানসেটের সাক্ষী হলাম। এতো সুন্দর সানসেট যে মন প্রাণ ভোরে গেল। ইচ্ছে করছিলো গাড়ি থেকে নেমে যাই আর নদীর পাড়ে গিয়ে বসে থাকি। শেষমেশ আমরা যখন ডাল লেক এর শেষ গেটে এ পৌঁছাই সুজ্জি মামা প্রায় নিভু নিভু। গাড়ি থেকে নামতেই কোথা থেকে একরাশ ঠান্ডা হাওয়া এসে ঘিরে ধরলো। এদিকে আমার কাছে কোনো ঠান্ডার জামাকাপড় নেই। আপনারা এই ভুলটা করবেন না - কাশ্মীরে সব জায়গাতেই বিকেল নামলেই পরিবেশ ঠান্ডা হয়ে যে - সাথে গরম জামাকাপড় রাখবেন।
ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে এগিযে গেলাম ঘাটের ভেতরে শিকারার দাম জানার জন্যে। আমি আগেই জেনে রেখেছিলাম যে ৭০০-৮০০ র মধ্যে দাম হওয়া উচিত ( গভর্নমেন্ট রাতে ) আর বার্গেইন করতে পারলে আরো কম। কিন্তু ওখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করে জানলাম ২০০০ টাকার নিচে কেউ রাজি নয়। এই ব্যাপার টা এইজন্য যে আমরা সবচেয়ে শেষের ঘাটে ছিলাম যেখানে খুব কম শিকারা ছিল , সাইটসিইং পয়েন্ট থেকে দূরে ছিল তাছাড়া সন্ধের সময় ওরা দরদাম বেশি করে। আমরা আর বার্গেইন না করে বেরিয়ে এলাম। দেখলাম অন্য আর একটা বাঙালি টুরিস্ট দের গ্রুপেরও একই অবস্থা। ঘাটের পাশ দিয়ে বেশ সুন্দর বসার জায়গা আছে সেখানেই বসে সূর্যাস্তর শেষ টুকু দেখলাম। মজার কোথা ওখানে কলকাতা বা বিহারের ফুচকা, ঝালমুড়ি পাবেন বিকেলবেলায় - চাইলে খেতে পারেন।
প্রাণবন্ত বুলেভার্ড রোড শ্রীনগরের প্রাণকেন্দ্র। একদিকে ডাল লেক এবং অন্যদিকে জমজমাট দোকান বাজার, সন্ধে নামলে এই রাস্তাটা এক অন্য রূপ নিয়ে নেয়। ঠান্ডা বেড়ে চলেছিল এদিকে খুরশিদ ভাইয়ের বাড়ি টানমার্গে যেতে সময় লাগবে তাই আমাদের তাড়াও দিচ্ছিলেন। তাই আমরা হোটেল ফেরার পথ ধরলাম। মাঝে একটা ছোট গ্রোসারি শপ থেকে তিনটে বিশ্লেরি বোতল নিয়ে নিলাম হোটেলের দেয়া জল খাবো না বলে। হোটেল টা এমন ভেতরে যে নিজস্ব গাড়ি ছাড়া পৌঁছানো কঠিন। আমাদের নামিয়ে খুরশিদ ভাই চলে গেলেন। পরের দিন তাড়াতাড়ি বেরোবো জানিয়ে দিলাম।

Dal Lake

Srinagar sunset



দিনের শেষ
রুমে পৌঁছানোর পর প্রথমেই যেটা করেছিলাম তা হল নিজেদের গরম জামাকাপড়ে মুড়ে নেওয়া। পর্যাপ্ত গরম জামাকাপড় আনা সত্যিই একটি ভাল সিদ্ধান্ত ছিল কারণ শ্রীনগরেই রাতে খুব ঠান্ডা লাগছিলো। আমরা ৮ টা নাগাদ ডিনার সেরে নি। বুফে ডিনার ছিল। খাবারের মান আর স্বাদ নিয়ে কিছু না বলাই ভালো। কাশ্মীরের সবচেয়ে বিস্বাদ খাবার আমরা এই হোটেলেই খেয়েছিলাম। যাইহোক খেয়ে দেয়ে আমরা রিসেপশন এ চলে আসি, ভেবেছিলাম বাইরে একটু হাটবো কিন্তু যা ঠান্ডা বাইরে তাতে হাঁটা গেলো না। রিসেপশনের উল্টো দিকে একটা কাশ্মীরি জিনিসের দোকান ছিল সেটা ঘুরে দেখলাম আমরা, কিন্তু দাম প্রচন্ড আর কতটা আসল নকল জিনিস টা বোঝার উপায়ে নেই। তাই আমরা কিছু কিনলাম না।
এরপর আমরা রুমেচলে আসি। প্রথম দিন টা মিলিয়ে মিশিয়ে কাটলো - কিন্তু ডাল লেকের সৌন্দর্য দেখে বাকি সব খারাপলাগা গুলো অনায়েসে ভুলে যাওয়া যায়। পরের দিন কতটা ঘটনাবহুল হবে টা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম।


প্রথম দিনের থেকে কিছু টিপস :
-------------------------------
  • এমন ফ্লাইট নেবেন যাতে আপনি দিনে দিনে বা দুপুরের মধ্যে শ্রীনগর পৌঁছাতে পারেন। তাতে কিছুটা সময় পাবেন সাইটসিইং এর।
  • এয়ারপোর্ট থেকে শ্রীনগরের দূরত্ব প্রায় ঘন্টা খানেক তাই, এয়ারপোর্ট থেকে বেরোনোর আগেই একবার ওয়াশরুম হয়ে আসবেন । লাগেজ বেল্টের পাশেই আছে ওয়াশরুম।
  • শ্রীনগরের ২ ষ্টার হোটেলের মান খুব খারাপ ছিল যেখানে আমরা ছিলাম তাই মিনিমাম ৩ ষ্টার নেয়া ভালো। যদি ডাল লেকের কাছে না হয়ে শহরের মধ্যে হয়ে তাহলেও অসুবিধে নেই, আপনি রাস্তায় অটো পেয়ে যাবেন যেকোনো জায়গায় যাওয়ার জন্যে। অটো মোটামুটি ঠিক দাম ই নেয়।
  • সানসেট শিকারা রাইড করতে হলে আগে পৌঁছাবেন ঘাট এ নাহলে বুলেভার্ড রোড এ ট্রাফিক এ ফেঁসে যাওয়ার চান্স আছে।
  • যেকোনো মুঘল গার্ডেন ভালো করে ঘুরে দেখতে হলে হাতে ১-২ ঘন্টা সময় নিয়ে যান। বাগানগুইতে অনেক হাঁটতে হয়ে তাই বয়স্ক লোকেদের অসুবিধা হতে পারে। সাথে জল রাখুন।
  • গার্ডেন গুলোর সামনে থেকে স্যুভেনির না কিনে নিগীন লেক এর সামনে থেকে কিনুন সস্তায় পাবেন।
  • শিকারা রাইড নেবেন মাঝের ঘাট নম্বরগুলি থেকে যেমন ১৭, ১৮ , ১৯ ইত্যাদি। রেট ভালো পাবেন কারণ ওখান থেকে সব কটা ভিউপয়েন্ট মোটামুটি কাছেই।
  • শিকারা রাইডের জন্যে দরদাম করতে হবে যতটা পারেন। ওরা এক ঘন্টা ঘোরাবে বললে তার অর্থ হলো শপিং এর টাইম বাদ দিয়ে আপনি এক ঘন্টা পাবেন। একবার শিকারে উঠে পড়লে তারপর ইচ্ছে মতো ঘন্টা বাড়ানো যে এক্সট্রা পে করে। দরদাম করে দাম কমিয়ে তারপর নামার সময় কিছু টিপস দিলে ভালো হয়ে।
  • বিকেল নামলেই কিন্তু কাশ্মীরের যে কোনো জায়গায় ঝপ করে ঠান্ডা নামে, তাই গরম জামা সাথে রাখুন।
  • কাশ্মীরে সন্ধে দেরিতে হয় আর সকাল তাড়াতাড়ি হয় সেটা খেয়াল রাখবেন।
  • আমরা সবসময়ে গ্রোসারি স্টোর থেকে বিশ্লেরির বোতল কিনে নিতাম যাতে এখান সেখানের জল না খেতে হয়। হোটেল থেকে গ্রোসারি দোকানে জল সস্তায় (রিটেল দামে) পাবেন তাই দরকার মতো একসাথে কিনে গাড়িতে রেখে দেবেন।
  • হোটেলে ব্রেকফাস্ট আর ডিনার বা শুধু ডিনার টা ইনক্লুড করে নেবেন স্টের সাথে তাহলে রাতে আর খাবার জায়গা খুঁজতে বেরোতে হবে না। এর তখনি একমাত্র ব্যতিক্রম হতে পারে যদি আপনি বুলেভার্ড রোড এই হোটেল পান। ওখান থেকে হাঁটা পথে অনেক খাবার দোকান পাবেন।
  • প্রথম দিনটা একটু তাড়াতাড়ি হোটেল এ গিয়ে বিশ্রাম করুন, যাতে পরের দিন থেকে একদম ফ্রেশ মুড এ ঘুরতে পারেন।
এবারের কিস্তিটা কেমন লাগলো অবশ্যই জানাবেন। পরের কিস্তিতে শ্রীনগর থেকে গুৱেজ যাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা নিয়ে ফিরে আসবো। ভালো থাকবেন সবাই।

#Kashmir #offbeatkashmir



 




No comments:

Post a Comment